Friday, July 22, 2011

ঋগ্বেদ পরিচয় - (১) বৈদিক সাহিত্য

মুন্ডক উপনিষদে একটি বচন আছে। তা দিয়ে আমাদের আলোচনা আরম্ভ হতে পারে। বচনটি এইঃ

দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে এতি স্ম যদ্ব্রহ্মবিদো বদন্তি পরা চৈবাপরা ব ৷৷ ৪ তসপরা ঋগ্বেদঃ যজুর্বেদো সামবেদোহথর্ববেদঃ শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষ্মিতি। অথ পরা যয়া তদক্ষরষধিগম্যতে ৷৷ ৫ (প্রথম খন্ড)

তার অর্থ হলঃ ব্রহ্মবিদরা বলে থাকেন দুটি বিদ্যা আয়ত্ত করতে হবে, পরা এবং অপরা। অপরা হল ঋগবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। আর পরা বিদ্যা হল তাই যার দ্বারা ব্রহ্মকে অধিকার করা যায়।

এই উক্তিতে বৈদিক সাহিত্যের একটি সম্পূর্ণ তালিকা পাওয়া যায়। দুভাগে বৈদিক সাহিত্যকে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগে আছে ব্রহ্মবিদ্যা অর্থাৎ বিশ্বের মধ্যে যে অবিনাশী সত্তা প্রচ্ছন্নভাবে ক্রিয়াশীল তার সন্বন্ধে জ্ঞান সঞ্চয় করা। এই জ্ঞান লিপিবদ্ধ হয়েছিল বেদেরই অঙ্গীভূত এবং আশ্রিত এক শ্রেণীর রচনায়। তাদের আমরা উপনিষদ বলি। উপনিষদ অর্থে বুঝি বেদের প্রান্তে যা অবস্থিত। বেদান্ত অর্থেও তাই বুঝি। পরবর্তীকালের শঙ্করাচার্য প্রবর্তিত বেদান্ত দর্শন এই উপনিষদ বা বেদান্তের রচনাকেই অবলম্বন করে রচিত হয়েছিল।

দ্বিতীয় ভাগে পড়ে আর সব কিছু। তাদের মধ্যে প্রথম আছে চারটি বেদ - ঋক্, সাম, যজু এবং অথর্ব। তারপর যেগুলি আছে সেগুলি সংখ্যায় ছটি এবং তাদের সাধারণ নাম বেদাঙ্গ। তারা হল শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। তাদের কেন বেদাঙ্গ বলা হয় তা বুঝতে কিছু প্রাথমিক কথা বলার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

ধর্মগ্রন্থ হিসাবেই বেদের উৎপত্তি। ধর্মের প্রধান উৎস হল বিশ্বের মূল শক্তিকে শ্রদ্ধা, ভক্তি বা অর্ঘ্য নিবেদনের আকূতি। এই আকূতির প্রেরণা নানা রকম হতে পারে। এই প্রসঙ্গে গীতায় ব্যবহৃত বিশ্লেষণটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। গীতায় বলা হয়েছে চার শ্রেণীর ভক্ত হতে পারেঃ আর্ত, অর্থাথী, ভক্ত ও জিজ্ঞাসু। যে আর্ত সে বিপদে পড়ে বিপদ হতে পরিত্রাণের জন্য পরম সত্তার সাহায্য প্রার্থনা করে। যে অর্থাথী তার কোনও বিপদ ঘটেনি, কিন্তু কোনও বিশেষ ইচ্ছা পুরণের জন্য ঈশ্বরের প্রসাদ প্রার্থনা করে। যে ভক্ত, সে আরও উচ্চ স্তরের মানুষ। তার কোনও ব্যবহারিক প্রয়োজন নেই। ঈশ্বরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা হেতু সে অহেতুক শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আর যে জিজ্ঞাসু সে পরম সত্তাকে জানতে ইচ্ছা করে।

বেদ অতি প্রাচীনকালে রচিত হয়েছে। সে যুগে মানুষ ভক্তের স্তরে উঠতে শেখেনি। সে যুগে দেবতার উপাসনার প্রেরণা ছিল ব্যবহারিক প্রয়োজন। অর্থাৎ আর্ত বা অর্থাথীর  মনোভাব নিয়ে দেবতার পূজা হত।

বেদের যুগে উপাসনা রীতির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। ঠিক বলতে কি তা অনন্য-সাধারণ। এ ধরনের রীতি অন্য কোনও দেশে দেখা যায়নি। অবশ্য পারসিক সম্প্রদায় অগ্নির উপাসনা করে। তবে বৈদিক যজ্ঞরীতি ভিন্ন ধরনের। প্রকৃতির বক্ষে যেখানে সেকালে ঋষি শক্তির বা সৌন্দর্যের উৎস আবিষ্কার করেছে, তার ওপরেই দেবত্ব আরোপ করে তার জন্য স্তোত্র রচনা করেছেন। এই স্তোত্রের নাম হল সূক্ত। এইভাবে অগ্নি দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি শুধু দেবতা নন পুরোহিতও বটেন; কারণ অগ্নিতেই অন্য দেবতার উদ্দেশে আহুতি দেওয়া হত। বায়ু দেবতার পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, জলের দেবতা বরুণ অধিষ্ঠিত হয়েছেন। আকাশের সূর্য মহাশক্তির উৎস তিনিও দেবত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ভোরবেলায় আকাশের রাঙিমা ঋষির মনকে মুগ্ধ করেছে। তিনিও ঊষা নামে অভিহিত হয়ে দেবত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। পৃথিবী ও আকাশ দ্যৌ নামে দেবতা পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এঁদের এবং অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে স্ত্রোত্র রচিত তাই নিয়েই বেদের জন্ম।

সূক্ত নিয়ে গঠিত বেদের এই মূল অংশকে বলা হয় সংহিতা। পরবর্তীকালে তার সঙ্গে অন্য অংশ যুক্ত হয়েছে। বেদের সূক্তগুলি রচিত হয়েছে প্রাচীন ভাষায়। বেদে তা ব্যবহৃত হয়েছে বলে আমরা তাকে বৈদিক ভাষা বলি। এখন শ্রদ্ধা নিবেদন বা প্রার্থনা জ্ঞাপন শুধু স্তোত্র পাঠেই হয় না। তার সঙ্গে কিছু আনুষঙ্গিক ক্রিয়া থাকে। বৈদিক যুগে সেই আনুষ্ঠানিক অংশ প্রধানতঃ রূপ নিত যজ্ঞানুষ্ঠানের। এই যজ্ঞের উপকরণ খুব সরল ছিল। একটি বেদী নির্মিত হত। তার উপর কাঠ দিয়ে আগুন জালানো হত। সেই সঙ্গে বৈদিক মন্ত পাঠ হত বা সুর সংযোগে গাওয়া হত। তার সঙ্গে ঘৃতের আহূতি দেওয়া হত। সোম নামে এক লতা সেকালে জন্মাত। তার রসও আহূতি হিসাবে দেবতাদের উদ্দেশ্য নিক্ষিপ্ত হত।

এখন বিভিন্ন ধরনের যজ্ঞ আছে। কোনোটিকে বলা হয় অগ্নিষ্টোম, কোনোটিকে জ্যোতিটোম, কোনটিকে বিশ্বজিৎ। আবার কতদিন ধরে একটি যজ্ঞ স্থায়ী হত তার ভিত্তিতে বিভিন্ন নামকরণ হত। যেমন যে যজ্ঞ বারো দিনের বেশী স্থায়ী হত তাকে বলা হত সত্র। এইসব বিষয় বিধি-নিষেধ নির্দেশ করবার জন্য ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হয়। এই ব্রাহ্মণগুলিতে বিভিন্ন যজ্ঞ কি করে নিষ্পাদিত করতে হয় তার সবিস্তার বিবরণ আছে। যেমন ঋগ্বেদের অন্তর্ভূক্ত ঐতরেয় ব্রাহ্মণে রাজসূয় যজ্ঞের বিবরণ আছে। ব্রাহ্মণগুলি সংস্কৃত ভাষায় রচিত।

আপস্তম্ব শ্রৌত সূত্রে বলা হয়েছে ''মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম্'' (২৪।১।৩১৬) অর্থাৎ সংহিতা অংশে সেখানে সূক্তগুলি আছে এবং ব্রাহ্মণ যেখানে যজ্ঞের বিধি নির্দেশ করা হয়েছে এ নিয়ে বেদ। অনেকগুলি মন্ত্র নিয়ে এক একটি সূক্ত রচিত হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি আরণ্যক ও উপনিষদও বেদের অঙ্গ। তাদেরও ব্রাহ্মণের অংশ ধরে নিতে হবে। তা না হলে তারা বাদ পড়ে যায়। ঠিক বলতে কি বৈদিক ঐতিহ্য অনুসারে আরণ্যকগুলি ব্রাহ্মণের অংশ এবং উপনিষদ গুলি আরণ্যকের অংশ। তাই জৈমিণি বলেছেন মন্ত্রাতিরিক্ত বেদভাগের নামই ব্রাহ্মণ। (মীমাংসা সূত্র, ২।১।৩৩)।

আরণ্যক ও উপনিষদ ব্রাহ্মণের অঙ্গ হলেও তাদের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য আছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ এই সমগ্র সাহিত্যকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি কর্মকান্ড ও অপরটি জ্ঞানকান্ড। কর্মকান্ডে যজ্ঞ সম্পর্কিত বিষয়গুলি আছে। সুতরাং তার অন্তর্ভূক্ত হবে বেদের সংহিতা বা মন্ত্র অংশ এবং ব্রাহ্মণ অংশ; কারণ তাতে যজ্ঞের বিধি-নিষেধের আলোচনা আছে। উপনিষদে ব্রহ্মতত্ত্বের বিষয় আলোচনা আছে সুতরাং তা জ্ঞান-কান্ডের মধ্যে গিয়ে পড়ে। আরণ্যকের স্থান এদের মধ্যবর্তী। এতে কর্ম অর্থাৎ যজ্ঞ এবং জ্ঞান উভয় সন্বন্ধেই আলোচনা পাওয়া যায়। প্রতি বেদের সঙ্গে সংযুক্ত ব্রাহ্মণ পাওয়া যায়; কিন্তু প্রতি বেদের সঙ্গে সংযুক্ত আরণ্যক পাওয়া যায় না। যেমন অথর্ববেদের একটি ব্রাহ্মণ আছে; কিন্তু তার অন্তর্ভূক্ত কোনও আরণ্যক পাওয়া যায় না।

সুতরাং জ্ঞানকান্ড হিসাবে উপনিষদেরই ভুমিকা প্রধান। সেই কারণে আমাদের উপনিষদের বিষয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। তার আগে যজ্ঞানুষ্ঠানের বিষয় কিছু প্রাথমিক কথা বলা প্রয়োজন।

যজ্ঞানুষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন ভূমিকা থাকত। যজ্ঞের সংজ্ঞা হিসাবে বলা হয়েছে 'দেবতার উদ্দেশ্যে দ্রব্য ত্যাগ যজ্ঞ।' অর্থাৎ যজ্ঞ করতে যে সমস্ত সামগ্রীর প্রয়োজন হতো, যেমন সমিধ বা কাঠ, আহুতির জন্য ঘৃত, সোমরস প্রভৃতি সরবরাহ করতে হত। যিনি দ্রব্য ত্যাগ করেন তিনি হলেন যজমান। অর্থাৎ তাঁরই কল্যাণ কামনায় যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো সুতরাং তাঁকেই এই দ্রব্যগুলি সরবরাহ করতে হত।

আর যাঁরা যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন তাঁদের বলা হতো ঋত্বিক। এই ঋত্বিকদের মধ্যে আবার ভূমিকা বিভিন্ন ছিল। তার ভিত্তিতে তাঁদের মধ্যে শ্রেণী বিভাগ আছে। যেমন যিনি সূক্ত পাঠ করতেন তাঁর নাম হল হোতা। যিনি এই সূক্ত গান করে পাঠ করতেন তাঁর নাম হল উদ্গাতা। আর যিনি অগ্নিতে আহুতি দিতেন তাঁর নাম হল অধ্বর্যু। সুতরাং বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে অনেকের ভুমিকা ছিল। আগুন জ্বেলে একটি ভাবগম্ভীর সমাবেশে তা অনেকের সাহচর্যে অনুষ্ঠিত হতো।

বৈদিক যজ্ঞের সন্বন্ধে একটি অপবাদ প্রচারিত আছে যে তাতে অনেক পশুবলি হত। এমন কি কবি জয়দেব রচিত 'গীতাগোবিন্দ' কাব্যে দশাবতারের বর্ণনায় পশু হত্যার উল্লেখ আছে। পশু যে বলি হতো না তা নয়। তবে তার সংখ্যা খুব সীমাবদ্ধ ছিল। কতকগুলি নির্বাচিত যজ্ঞে কেবল পশুহত্যার ব্যবস্থা ছিল। আহিতাগ্নি যজ্ঞে পশুবধ অবশ্য-কর্তব্য ছিল; কিন্তু তাতে মাত্র একটি পশু বলি হত। সোমযাগে একাধিক পশু ব্যবহৃত হত। কিন্তু তাদের সংখ্যা নির্দিষ্ট ছিল। তাছাড়া এ যাগ অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য হওয়ায় খুব কম সংখ্যায় অনুষ্ঠিত হত। (অনির্বাণ-বেদ মীমাংসা, ২য় খন্ড পৃঃ ৪৪১)। অশ্বমেধ যজ্ঞের বিবরণ আমরা পাই। তাতে কেবল একটি অশ্ব হত্যা করা হত।

এখন আমরা উপনিষদের আলোচনায় ফিরে যাব। উপনিষদের অর্থ নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। প্রথমেই যে বিষয় আলোচনা করে নিতে পারি।

ডয়সন উপনিষদকে রহস্যগত জ্ঞান বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে এই জ্ঞান রহস্যপূর্ণ হওয়ায় গুরুর নিকট একান্তে বসে আলোচনা হতেই এই বিদ্যা সম্ভব। গুরুর সন্নিধিতে বসে আয়ত্ত হত বলে তার নাম উপনিষদ (Deussen, Philosophy of Upanishads p. 14-15).

ম্যাক্সমূলার বলেছেন প্রথমে উপনিষদ বোঝাত একটি সভা। সেখানে গুরু হতে একটি ব্যবধান রক্ষা করে শিষ্যরা তাঁকে ঘিরে সমবেত হত। শিষ্য গুরুর নিকটে বসে এই বিষয় চর্চা করত বলেই এর নাম উপনিষদ। (Maxmuller, Sacred Books of the East, Introduction)

অষ্টোত্তর শত উপনিষদের সংকলক পন্ডিত বাসুদেব শর্মা বলেনঃ উপ অর্থে গুরুর উপদেশ হতে লব্ধ; নি অর্থে নিশ্চিত জ্ঞান; সৎ অর্থে যা জন্মমৃত্যুর বন্ধনকে খন্ডন করে। সুতরাং অর্থ দাঁড়ায় গুরুর নিকট হতে লব্ধ যে নিশ্চিত জ্ঞান জন্মমৃত্যুর বন্ধন খন্ডন করে তাই হল উপনিষদ।

মনে হয় উপনিষদের একটি সহজ ব্যুৎপত্তিগত অর্থ পাওয়া যায়। অপরদিকে উপরের ব্যাখ্যাগুলির বিপক্ষে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। উপনিষদের অলোচনা গুরুশিষ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত না। বৃহদারণ্যক উপনিষদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখি ব্রহ্মতত্ত্বের আলোচনা অনুষ্ঠিত হত। কাজেই দয়সন ও ম্যাস্কমূলারের উক্তি সম্পূর্ণভাবে সমর্থিত হয় না।

বাসুদেব শর্মা মুক্তির উপায় হিসাবে উপনিষদের ব্যবহার করেছেন এবং সেই অর্থ তার মধ্যে আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু উপনিষদের যুগে মুক্তির স্পৃহা মানুষের মধ্যে বলবতী হয়নি। সেটা ঘটেছিল পরবর্তীকালে ষড় দর্শনের যুগে। কর্মফল ও পরজন্মবাদ বদ্ধমূল সংষ্কারে রূপান্তরিত হবার পরেই মুক্তির চিন্তা ভারতীয়দের মনে উদয় হয়। উপনিষদের যুগে জন্মান্তরবাদ ঠিক গড়ে ওঠেনি। এ বিষয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলেছে মাত্র। কাজেই তখন মুক্তি-স্পৃহা জানবার নময় আসেনি। বিশ্ব হতে পলায়ন করবার মনোভাব তখনো মানুষের মনে জাগেনি। জীবনকে আনন্দময় মনে করা হত। বিশ্বকে বলা হত 'আনন্দরূপম-মৃতং যদ্বিভাতি' (মুন্ডক ২।২।৭)। সুতরাং এই মানসিক পরিবেশে মুক্তিচিন্তা মানুষের মনে আসে না। কাজেই মনে হয় বাসুদেব শর্মার ব্যাখ্যা কল্পিত এবং গ্রহণযোগ্য নয়।

সুতরাং উপনিষদের সহজ সরল ব্যুৎপত্তিগত অর্থ গ্রহণ করাই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। উপনিষদ অর্থে বুঝি যা এক প্রান্তে অবস্থিত। বেদের এক প্রান্তে বসে আছে বলেই তা উপনিষদ। তাকে বেদান্তের সমার্থবোধক শব্দ হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। বেদান্তেরও অর্থ বেদের শেষে যা আছে তাই। শব্দটি শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে ব্যবহৃত হয়েছে।

আমরা এখানে বলেছিলাম যে উপনিষদগুলি বেদের আশ্রিত হয়ে গড়ে উঠেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে পরিস্থিতির অনুকূল্যে অন্য সূত্রেও অনেক উপনিষদ রচিত হয়েছে। তারা বেদের অঙ্গীভূত নয়।

এমন ঘটনার একটা কারণ ছিল। প্রাচীনকালে উপনিষদের মর্যাদা এমন বৃদ্ধি পেয়েছিল যে পরবর্তীকালে বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব উপনিষদ নামে প্রচারিত হয়েছিল। সম্ভবত নামের আভিজাত্যের গুণে তাদের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করবার ইচ্ছা এই রীতির পেছনে সক্রিয় ছিল। মুক্তিক উপনিষদে ১০৮ খানি উপনিষদের উল্লেখ আছে। নির্ণয় সাগর প্রেস হতে বাসুদেব লক্ষণ শাস্ত্রী উপনিষদের যে সংকলন গ্রন্থ বার করেছিলেন তাতে ১১২টি উপনিষদ স্থান পেয়েছে। তার যে সাম্প্রতিক সংস্করণ বেরিয়েছে তাতে ১২০ খানি উপনিষদ প্রকাশিত। এদের বেশীর ভাগই বেদের যুগে রচিত নয়, পরবর্তীকালে রচিত হয়েছিল। এখন আমাদের প্রকৃত বৈদিক যুগের উপনিষদ হতে পরবর্তীকালে রচিত উপনিষদগুলি পৃথক করে নেওয়া প্রয়োজন।

সৌভাগ্যক্রমে এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারে এমন দুটি অনুকূল অবস্থা পাওয়া যায়। প্রথমত দেখি ভারতীয় দাশর্নিক চিন্তার রূপ বিভিন্নকালে পরিবর্তিত হয়েছে। বেদের কর্মকান্ডে যে চিন্তা পাই উপনিষদে তা পাই না। বড় দর্শনের যুগে আবার চিন্তার রূপ পরিবর্তিত হয়েছে। পরে পৌরাণিক যুগে আবার চিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন উপনিষদগুলি বৈদিক সাহিত্যের কথা হিসাবে গড়ে উঠেছিল এবং একটি বিশেষ তত্ত্ব তাদের অবলম্বন করে গড়ে উঠেছিল। তাকে ব্রহ্মবাদ বলতে পারি। সুতরাং এই দুই লক্ষণ দ্বারা বৈদিক যুগের উপনিষদ গুলিকে পৃথক করে নিতে পারি। প্রথমত যে উপনিষদের চিন্তা প্রাচীন উপনিষদের চিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্গতি রাখে না তাকে পৃথক করে রাখতে পারি। দ্বিতীয়ত যে উপনিষদের বেদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সন্বন্ধ আবিস্কৃত হবে তাকে বৈদিক যুগের উপনিষদ বলে স্বীকার করে নিতে পারি।

ভারতীয় দার্শনিক আলোচনায় চারটি দার্শনিক চিন্তা কালানুক্রমে আবিস্কার করা যায়। প্রথমত বেদের কর্মকান্ডে সংহিতা অংশে প্রাচীনতম অবস্থাটি পায়। তখন নানা প্রাকৃতিক শক্তির উপর দেবত্ব আরোপ করে যজ্ঞে তাঁদের আহবান করে উপয়াসনা করা হত। এই উপাসনা রীতি বিশুদ্ধ ব্যবহারিক প্রয়োজন দ্বারা অনুপ্রাণিত। শত্রু হতে রক্ষা বা বিপদ হতে ত্রাণ এনং অভীষ্ট পূরণের জন্য এই উপাসনায় প্রার্থনা নিবেদিত হত। সঙ্গে সঙ্গে দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রশস্তিও নিবেদিত হত।

বেদের মধ্যেই শেষের দিকে জ্ঞানকান্ডের প্রতি ঝোঁক দেখা যায়। ঋগ্বেদের মধ্যেই বিশেষ করে দশম মন্ডলে এমন অনেক সূক্ত আছে যেখানে নানা দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এখানে যে চিন্তার সুত্রপাত হয়েছে তার বিকাশ ঘটেছে বিভিন্ন বেদের সহিত সংযুক্ত উপনিষদগুলির মধ্যে। এখানে ঋষির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি প্রবল হয়ে উঠেছে। ব্যবহারিক প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি বিশ্বসত্তার পরিচয় পেতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন। এই জিজ্ঞাসার ফলে যে দর্শন গড়ে উঠেছে তাকে আমরা সর্বেশ্বরবাদ বলতে পারি। এই দর্শন বলে সকল মানুষ, সকল জীব, সকল বস্তুকে জড়িয়ে নিয়ে এক মহাশক্তি সবকিছে ব্যাপ্ত করে আছেন এবং প্রচ্ছন্ন থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন। এইভাবে প্রাচীন উপনিষদে যে তত্ত্বটি গড়ে উঠেছে তাতে বিশুদ্ধ জিজ্ঞাসুর দৃষ্টিভঙ্গী পাই।

আমাদের দেশের দার্শনিক চিন্তার পরবর্তী যুগটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গীরই একটি পরিবর্তিত রূপ। এখানেও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গী ক্রিয়াশীল, তবে প্রেরণা এসেছে ভিন্ন পথে। এখানে প্রেরণা এসেছে ব্যবহারিক প্রয়োজনে। এ যুগে কর্মফল তত্ত্ব এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত পরজন্মবাদ বদ্ধমূল সংস্কারে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে এই ধারণা গড়ে উঠেছে যে পার্থিব জীবন সুখের নয়, দুখের। ফলে পরজন্ম হতে মুক্তির আকাঙ্খা তীব্র হয়ে উঠেছে। সেই মুক্তির উপায় হিসাবে জ্ঞান-মার্গকেই অবলম্বন করা হয়েছে। একথা যেমন হিন্দু ষড় দর্শন সন্বন্ধে খাটে তেমন বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন সন্বন্ধেও খাটে। বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনও পরজন্ম হতে পরিত্রাণ চায় এবং তার ব্যাখ্যার জন্য স্বতন্ত্র দর্শন গড়ে তুলেছে। অবশ্য উভয়ক্ষেত্রেই দর্শন ব্যতীত একটি কর্মরীতি প্রচার করা হয়েছে। ভগবান বুদ্ধ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ প্রবর্তন করেছিলেন। অনুরূপভাবে জৈন ধর্মে সম্যক চরিত্রকেও মোক্ষলাভের অন্যতম উপায় হিসাবে স্বীকার করা হয়েছে। সুতরাং এই অবস্থায়ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল।

চতুর্থ অবস্থায় পৌরাণিক যুগে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়ে ভক্তের দৃষ্টিভঙ্গি আসে। সাধারণভাবে বলা যায় ষড় দর্শনের যুগে ভক্তের দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্ফুট ছিল না। তবে তার প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল। বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন ঈশ্বর সন্বন্ধে একেবারে নীরব। ষড় দর্শনের মধ্যে অধিকাংশ দর্শনই ব্যক্তিরূপী ঈশ্বর সন্বন্ধে নীরব। পুর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা এ প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত নয়। সাংখ্য দর্শনেও ঈশ্বরের স্বীকৃতি নেই। বৈশেষিক দর্শনেও নেই। যোগ দর্শনে ঈশ্বর নানা তত্ত্বের মধ্যে একটি অতিরিক্ত তত্ত্ব হিসেবে স্বীকৃত। একেশ্বরবাদের ঈশ্বর যে মহিমায় অধিষ্ঠিত তার ধারে কাছেও তিনি যান নে। ন্যায় সূত্রে ঈশ্বরের উল্লেখ আছে কিন্তু এখানে তাঁর অস্তিত্বের প্রমাণই মুখ্য বিষয়। ভক্তির দৃষ্টিভঙ্গি এখানেও অনুপস্থিত। পূর্ব মীমাংসায় বেদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বৈদিক দেবতারা স্বীকৃত; কিন্তু একশ্বরবাদের দেবতার বিষয় তা উদাসীন।

তারপর এসেছে পৌরাণিক যুগ। তখন দেখি ঈশ্বরকে বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করে তাঁর ওপর সকল মৌলিক শক্তি আরোপ করে তাঁকে ব্যক্তিরূপী সত্তা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। তখনই ভারতের চিন্তাধারায় একেশ্বরবাদ পূর্ণ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিব বা শক্তি বা বিষ্ণু বা তাঁর অবতাররূপে গ্রহণ করে ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান ও ব্যক্তিরূপী বলে গ্রহণ করা হয়েছে। তিনিই একমাত্র অবলম্বন এবং একমাত্র গতি। ঈশ্বরে ভক্তিই এখানে মূল সুর রূপে পরিস্ফুট হয়েছে।

সুতরাং ভারতীয় দর্শনের চিন্তায় চারটি স্তর পাই। প্রথমে বেদের কর্মকান্ডের যুগ। সেখানে প্রকৃতির বহু শক্তিকে দেবতারূপে স্বীকৃতি দান করা হয়েছে। ধর্ম সেখানে ব্যবহারিক প্রয়োজনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গিরও সহাবস্থিতি ঘটেছিল। দ্বিতীয় অবস্থা পাই উপনিষদের যুগে। সেখানে মানুষের মন ব্যবহারিক প্রয়োজন বোধকে উপেক্ষা করে জ্ঞানমার্গে বিশ্বসত্তাকে জানবার জন্য আগ্রহশীল হয়েছিল। ফলে ব্রহ্মবাদ গড়ে উথেছিল - তৃতীয় স্তর পড়ে ষড় দর্শনের যুগে। তখন ব্যবহারিক প্রয়োজনবোধের আবার আবির্ভাব হয়েছে, কিন্তু ভিন্ন ভাবে। দুঃখ হতে পরিত্রাণ বা ইচ্ছা পুরণের জন্য নয়, জন্মবন্ধন হতে মুক্তিলাভের জন্য। তবে তার উপায় হিসাবে জ্ঞানমার্গকেই অবলম্বন করা হয়েছে। শেষের অবস্থা পাই পূরাণের যুগে। তখন বিশ্বসত্তা ব্যক্তিরূপী ঈশ্বর হিসাবে কল্পিত হয়েছেন এবং তাঁর প্রতি অহেতুক ভক্তি হয়ে উঠেছে সাধনার রীতি।

মুক্তির উপনিষদে যে ১০৮ খানি উপনিষদের উল্লেখ আছে তা নির্ণয় সাগর প্রেসের সংকলনে যে অতিরিক্ত উপনিষদগুলির উল্লেখ আছে, সেগুলির বিষয়বস্তু বিচার করলে দেখা যাবে তারা এই চারশ্রেণীর মধ্যে পড়ে যাবে। সেই শ্রেণীগুলি দাঁড়াবে এইঃ

(১)  ব্রহ্মবাদী উপনিষদ;
(২)  সন্ন্যাসবাদী উপনিষদ। এগুলির উপর যোগদর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট।
(৩)  যোগবাদী উপনিষদ। এগুলি যোগ অভ্যাসে উৎসাহ দেয়;
(৪)  ভক্তবাদী উপনিষদ যা বিভিন্ন পৌরাণিক দেবতার আরাধনায় উৎসাহ দিয়েছে।

এদের মধ্যে বেদের অঙ্গীভুত বা বৈদিক যুগের উপনিষদগুলি প্রথম শ্রেণীতে পড়বে। অন্যগুলিকে বৈদিক সাহিত্যের অংশ বলে স্বীকার করা যায় না। তারা অনেক পরে রচিত হয়েছে।

এখন আমরা দেখব যে উপনিষদগুলি প্রথম শ্রেণীতে স্থাপন করা যায় তাদের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত তারা সকলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা প্রভাবান্বিতএবং এক সর্বব্যাপী প্রচ্ছন্ন সত্তার পরিছয় দেয়। অর্থাৎ তারা ব্রহ্মবাদী। দ্বিতীয়ত তারা হয় বেদের সঙ্গে সোজাসুজি যুক্ত না হয় ঐতিহ্য অনুসারে যুক্ত। যেখানে তারা বেদের সঙ্গে সোজাসুজি যুক্ত সেখানে তারা বেদের সংহিতা অংশ বা ব্রাহ্মণ অংশ বা আরন্যক অংশের অঙ্গীভূত। এইভাবে আমরা ১২ খানি উপনিষদ আবিস্কার করি যাদের পূর্বের তালিকার প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত এবং বৈদিক সাহিত্যের অঙ্গ হিসাবে পরিগণিত করতে পারে। নীচে তাদের একটা তালিকা দেওয়া হল।

(ক)  বেদের অঙ্গীভূত উপনিষদঃ
       (১)  ঈশ, শুক্ল যজুর্বেদের বাজসনেয় সংহিতার অংশ
       (২)  ঐতরেয়, ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যকের অংশ
       (৩)  কৌষীতকি, ঋগ্বেদের শাংখ্যায়ন আরণ্যকের অংশ
       (৪)  তৈত্তিরীয়, কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের অংশ
       (৫)  বৃহদারণ্যক, শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণের অংশ
       (৬)  কেন, সামবেদের জৈমিনীয় বা তলবকার ব্রাহ্মণের অংশ
       (৭)  ছান্দোগ্য, সামবেদের ছান্দোগ্য ব্রাহ্মনের অংশ
       (৮)  প্রশ্ন, অথর্ববেদের পৈপ্পলাদ শাখার অন্তর্ভূক্ত
(খ)  ঐতিহ্য অনুসারে বেদের সহিত সংযুক্তঃ
       (৯)   কঠ, ঐতিহ্য অনুসারে কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্ভূক্ত
       (১০) শ্বেতাশ্বতর, ঐতিহ্য অনুসারে কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্ভূক্ত
       (১১)  মুন্ডক, ঐতিহ্য অনুসারে অথর্ব বেদের অন্তর্ভূক্ত
       (১২)  মান্ডুক্য, ঐতিহ্য অনুসারে অথর্ব বেদের অন্তর্ভূক্ত

আমরা চারটি বেদের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। তারা হল, ঋক্, সাম, যজুঃ এবং অথর্ব। আমরা আরও বলেছি মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ নিয়ে উপনিষদ এবং ব্রাহ্মণের অন্তর্ভূক্ত হল আরণ্যক ও উপনিষদ। এই বিভাগ মোটামুটি প্রতিটি বেদ সন্বন্ধে প্রযোজ্য। এখন কোন বেদের সহিত কোন ব্রাহ্মণ, কোন আরণ্যক এবং কোন উপনিষদ সংযুক্ত তা দেখানো যেতে পারে।

ঋগ্বেদের সঙ্গে সংযুক্ত দুটি ব্রাহ্মণ আছে। তারা হল ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এবং কৌষীতকি বা শাঙ্খায়ন ব্রাহ্মণ। উভয় ব্রাহ্মণের সঙ্গে একই নামে চিহ্নিত আরণ্যক আছে। সুতরাং তাদের নাম ঐতরেয় আরণ্যক ও কৌষীতকি আরণ্যক। ঐতরেয় আরণ্যকের সঙ্গে সংযুক্ত ঐতরেয় উপনিষদ এবং কৌষীতকি আরণ্যকের সঙ্গে যুক্ত কৌষীতকি উপনিষদ।

সামবেদের অন্তর্ভূক্ত তিনটি ব্র৫য়াহ্মণ আছে। তারা হল তান্ড্য মহাব্রাহ্মণ, ষড়বিংশ ব্রাহ্মণ এনং ছান্দোগ্য বা জৈমিনীয় বা উপনিষদ ব্রাহ্মণ। এই আরণ্যক দুটির আশ্রিত দুটি উপনিষদঃ ছান্দোগ্য ও কেন।

বর্তমানে সামবেদের তিনটি শাখা পাওয়া যায়; কৌযুন, রাণায়ণীয় এবং জৈমিনীয় বা তলবকার। তাদের মধ্যে কৌযুন শাখাই বেশী প্রচলিত। সাম বেদের তিনটি প্রধান ব্রাহ্মণঃ জৈমিনীয় বা তলবকার ব্রাহ্মণ, তান্ড্য বা পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ এবং মন্ত্র বা ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ। কেন উপনিষদ তলবকার ব্রাহ্মণের অন্তর্ভূক্ত। ছান্দোগ্য উপনিষদ ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণের অংশ।

বর্তমান যজুর্বেদে দুটি শাখা পাওয়া যায়। শুক্ল যজুর্বেদ ও কৃষ্ণ যজুর্বেদ। শুক্ল যজুর্বেদ সুষ্ঠু যজ্ঞ প্রযুক্ত মন্ত্রের সংকলন। সেই কারণেই সম্ভবত তাকে শুক্ল বা বিশুদ্ধ বলা হয়। কৃষ্ণ যজুর্বেদে মন্ত্র ছাড়া অতিরিক্তভাবে যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যাখ্যাও আছে। সেইজন্যই সম্ভবত তার কৃষ্ণ যজুর্বেদ নাম। যজুর্বেদের মন্ত্রগুলি অধিকাংশ গদ্যে রচিত। এই মন্ত্রগুলি যিনি পাঠ করতেন তাঁকে অধ্বর্যূ বলা হত। শুক্ল যজুর্বেদের আর এক নাম বাজসনেয়ী সংহিতা। তার প্রাচীন আচার্য যাজ্ঞবল্ক্য বাজসনেয় হতে এ নাম হয়েছে।

কৃষ্ণ যজুর্বেদে একটি ব্রাহ্মণ আছে। তার নাম ঐত্তিরীয়। তার আরণ্যকের নামও তৈত্তিরীয়। সেই আরণ্যকের আশ্রিত উপনিষদের নামও তৈত্তিরীয়।

শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণ নামে একটি ব্রাহ্মণ আছে। তার আশ্রিত আরণ্যক এই ব্রাহ্মণেরি অংশ এবং একই নামে প্রচলিত। এই বেদের আশ্রিত দুটি উপনিষদঃ বৃহদারণ্যক ও ঈশ। বৃহদারণ্যক সব থেকে বড় উপনিষদ। ঈশ উপনিষদ এই বেদের সংহিতার অংশ।

অথর্ব বেদের প্রাচীন নাম ছিল অথর্বাঙ্গিরস। অথর্বন ও অঙ্গিরাগণ সুপ্রাচীনকালের ঋষি ছিলেন। সুতরাং তার উৎপত্তি প্রাচীনকালে হয়েছিল। তাকে তার প্রকৃতি দেখে মনে হয় তার অনেক অংশ অপ্রাচীনকালে রচিত হয়েছিল। অথর্ববেদের প্রধান্তম বিষয়বস্তু হল যাদুবিদ্যা। এক ধরনের যাদুবিদ্যার নাম ভৈষজ্যানি। তার উদ্দেশ্য নানা রোগের উপশম সাধন। এই উপশমের জন্য যেমন ভূত ঝাড়ানোর ব্যবস্থা আছে তেমন রোগ নিরাময়ের উপযোগী নানা রকম লতাগুল্মের ব্যবহারের নির্দেশ আছে।

অথর্বেদে একটি মাত্র ব্রাহ্মণ আছে। তার নাম গোপথ ব্রাহ্মণ। তার সঙ্গে সংযুক্ত কোনও আরণ্যক নেই। তবে প্রশ্ন উপনিষদ এই বেদের পৈপ্পলাদ শাখার অন্তভুর্ক্ত।

তারপর আসে বেদাঙ্গ। এই বিষয়গুলি বেদ পাঠ এবং যজ্ঞ অনুষ্ঠানে সাহায্যে করত বলে এদের নাম বেদাঙ্গ। এদের প্রয়োজন ব্যবহারিক। এবার বেদের পরিপূরক গ্রন্থ হিসাবে এর বর্ণনা করা যেতে পারে।

ছয়টি বেদাঙ্গের সন্ধান পাওয়া যায়। তাদের প্রথম উল্লেখ পাই ষড়বিংশ ব্রাহ্মণে। সেখানে উল্লেখ আছে "চত্বারোহস্যৈ (স্বাহায়ৈ) বেদাঃ শরীরং ষড়ঙ্গান্যঙ্গানি ৷৷ ৪ ৷৷ ৭" অর্থাৎ চারটি বেদ হল শরীর এবং ছয়টি বেদাঙ্গ হল তাদের অঙ্গ। এই ছয়টি বেদাঙ্গ হল শিক্ষা, ছন্দ, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, জ্যোতিষ এবং কল্প। এদের প্রত্যেকের পরিচয় নীচে দেওয়া হলঃ-

(১) প্রথমে শিক্ষা। সেকালে বেদ অধ্যয়ন নিত্য কর্তব্য ছিল। যজ্ঞেও বেদ পাঠের প্রয়োজন হত। দৈনিক পাঠকে স্বাধ্যায় বলা হত। শিক্ষক বেদের শব্দরাশির নির্ভুল উচ্চারণ শিক্ষা দিত। গুরুর কাছ থেকে শিষ্য তা গ্রহণ করত। বেদের সংহিতা অংশই প্রধানতঃ শিক্ষার আলোচনার বিষয়।

সংহিতা দুভাবে পাঠ করা হত। তার পাঠকে পদপাঠ বলা হত। তা দুরকম হতে পারে। অব্যাকৃত পদপাঠ এবং ব্যাকৃত পদপাঠ। সংহিতায় পরস্পর সন্নিবদ্ধ অবস্থায় যেমন পদগুলি আছে তেমনভাবে ভেখে পাঠ করাকে অব্যাকৃত পদপাঠ বলে। ব্যাকৃত পদপাঠে প্রতি পদকে সন্নিবদ্ধ রূপ হতে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে পৃথকভাবে উচ্চারণ করাকে ব্যাকৃত পদপাঠ বলে। একে শুধু পদপাঠও বলে। সংহিতা পাঠের সঙ্গে পদপাঠের সম্পর্ক নির্দেশ করতে প্রাতিশাখ্য গ্রন্থের উদ্ভব হয়। এগুলি শিক্ষার আদিগ্রন্থ।

প্রত্যেক বেদের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাতিশাখ্য সুত্র আছে। ঋগ্বেদের প্রাতিশাখ্য গ্রন্থ হল শাকল প্রাতিশাখ্য। সামবেদের প্রাতিশাখ্য গ্রন্থ অনেকগুলিঃ সামপ্রাতিশাখ্য, পুস্প সূত্র, পঞ্চবিধ সূত্র ও ঋকতন্দ্র ব্যাকরণ। কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্য সূত্র এবং শুক্ল যজুর্বেদের বাজসনেয় প্রাতিশাখ্য সূত্র। অথর্ববেদের দুটি প্রাতিশাখ্য সূত্রঃ অথর্ববেদ প্রাতিশাখ্য সূত্র এবং শৌনকীয় চতুরধ্যায়িকা।

প্রাতিশাখ্য গ্রন্থগুলি ছাড়াও ছন্দে রচিত কিছু শিক্ষাগ্রন্থ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে প্রধান হল ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদের পাণিনীয় শিক্ষা, সাম্বেদের বারদীয় শিক্ষা, কৃষ্ণ যজুর্বেদের ব্যাস শিক্ষা, শুক্লযজুর্বেদের যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা এবং অথর্ব বেদের মান্ডুক্য শিক্ষা।

(২) দ্বিতীয় বেদাঙ্গ ব্যাকরণ। ব্যাকরণের সঙ্গে শিক্ষার খানিকটা যোগ আছে। সংহিতার অব্যাকৃত পাঠকে সন্ধিবিচ্ছেদ করে ব্যাকৃতরূপে অর্থাৎ পদপাঠে পরিণত করতে সন্ধির নিয়মগুলি জানা দরকার। সেগুলি ব্যাকরণের বিষয়। অতিরিক্ত ভাবে বেদপাঠে বা যজ্ঞে তার আরও প্রয়োগ গাছে। মন্ত্রকে যজ্ঞে প্রয়োগ করবার সময় কোনও ক্ষেত্রে পদের লিঙ্গ বিভক্তি প্রভৃতির পরিবর্তন ঘটে। ব্যাকরণ না জানলে পদের অর্থগ্রহণ করা সহজ হয় না, ভাষাকে বিশুদ্ধ রাখাও প্রয়োজন। এইসব ক্ষেত্রে ব্যাকরণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

দুর্ভাগ্যক্রমে বেদাঙ্গ পদবাচ্য ব্যাকরণ এখন লুপ্ত হয়ে গেছে। তবে ব্যাকরণের ইতিহাস অতি প্রাচীনকাল পর্যন্ত বিস্তৃত। পানিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে চৌষট্টি জন পূর্বাচার্যের নাম করেছেন। সুতরাং ব্যাকরণ চর্চা বেদের যুগের আদিকাল হতেই প্রচলিত ছিল অনুমান করা যায়।

এই প্রসঙ্গে ঋগবেদের চতুর্থ মন্ডলের ৫৮ সূক্তের ৩ সংখ্যক মন্ত্রটি উল্লেখ করা যেতে পারে। পতঞ্জলি মনে করেন এই মন্ত্রটি ব্যাকরণকে উদ্দেশ্য করে বলা হইয়াছে। মন্ত্রটি এইঃ

চত্বারি শৃঙ্গাঃ ত্রয়োহস্য পাদাঃ দ্বে শীর্ষে সপ্ত হস্তাসো অস্য। ত্রিধা বদ্ধো বৃষভো রোরবীতি মহো দেবো মর্ত্যামাবিবেশ ৷৷ ৪ ৷৷ ৫৮ ৷৷ । এর বাংলা অনুবাদ এই রকম দাঁড়ায়ঃ

এঁর চারটি শৃঙ্গ, তিনটি পাদ, দুটি মস্তক ও সাতটি হস্ত। ইনি অভীষ্টবর্ষী, ইনি তিন প্রকারে বদ্ধ হয়ে অত্যন্ত শব্দ করছেন।

সায়ণাচার্যও একই মত পোষণ করেন। তাঁর 'ঋগবেদ ভাষ্যোপক্রমণিকায়' এই মন্ত্রটির একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। চারটি শৃঙ্গ অর্থে এই চারটি পদ আছে। তিনটি পদ হচ্ছে তিন কাল। দুই শীর্ষ হচ্ছে সুবন্ত এবং তিঙন্ত প্রত্যয়। সাতটি হাত হচ্ছে সাতটি বিভক্তি। রোরবীতির অর্থ শব্দকর্মক ধাতু।

(৩) তারপর ছন্দ। ছন্দ শিক্ষার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে যুক্ত। ঋক্ সংহিতার সন মন্ত্রই ছন্দোবদ্ধ। অবশ্য সাম সংহিতার মন্ত্র গাওয়া হত। অথর্ব সংহিতারও বেশীর ভাগ মন্ত্রই ছন্দোবদ্ধ। সংহিতায়, ব্রাহ্মণে এবং উপনিষদে নানা সুত্রে ছন্দের প্রসঙ্গ আছে।

সকল প্রাতিশাখ্যের শেষে সামবেদের নিদান সূত্রে এবং বিভিন্ন অনুক্রমণিকাতে ছন্দ সন্বন্ধে উল্লেখ আছে। পিঙ্গলের ছন্দঃ সূত্রকেই বেদাঙ্গ বলে বিবেচনা করা হয়। তবে এটিকে বিশুদ্ধভাবে বেদাঙ্গ গণ্য করা যায় না। তার প্রথম চার অধ্যায়ে বৈদিক ছন্দের আলোচনা আছে। তারপর অতিরিক্তভাবে লৌকিক ছন্দের ও বিবরণ আছে।

(৪) চতুর্থ বেদাঙ্গ হল নিরুক্ত। নিরুক্তের সঙ্গে নিঘন্টুর ঘনিষ্ঠ সংযোগ আছে। নিঘন্টু হল বৈদিক শব্দের সংগ্রহ। নিঘন্টুর মত তখন আরও অনেক শব্দ সংগ্রহ ছিল। সেগুলি লুপ্ত হয়ে গেছে। যাস্ক নিঘন্টু শব্দের যে ব্যাখ্যা করেছেন তাই নিরুক্ত নামে প্রচলিত।

নিঘন্টুতে তিনটি কান্ডে পাঁচটি অধ্যায় আছে। প্রথম তিনটি অধ্যায় নিয়ে নৈঘন্টুক' কান্ড। তাতে একার্থবাচক শব্দের সংগ্রহ আছে। চতুর্থ অধ্যায় হল 'ঐকপদিক' বা নৈগস কান্ড। তাতে একটি অর্থ সুচিত করে এমন শব্দের সংগ্রহ আছে। পঞ্চম অধ্যায় 'দৈবত কান্ড'। তাতে বেদের দেবতাদের নামের সংগ্রহ আছে।

নিরুক্তের দুটি ষটকে বারোটি অধ্যার আছে। প্রথম ষতকে নিরুক্তের প্রথম দুটি কান্ডের ব্যাখ্যা আছে। দ্বিতীয় ষটকে দৈবত কান্ডের ব্যাখ্যা আছে।

নিরুক্তের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ভেঙে বলা। এই অর্থে তা ব্যাকরণের পরিপূরক। ব্যাকরণ শব্দগুলিকে ভেঙে পৃথক করে দেয়। নিরুক্ত পদকে ভেঙে তার ব্যাখ্যা করে। ব্যাকরণের সন্বন্ধ শব্দের সহিত, নিরুক্তের সন্বন্ধ অর্থের সহিত পদকে ভাঙলে তবেই তার অর্থ গ্রহণ করে সহজ হয়। সুতরাং ব্যাকরণ ও নিরুক্ত পরস্পরের পরিপূরক।

(৫) পঞ্চম বেদাঙ্গ হল জ্যোতিষ। যিনি যজ্ঞের অনুষ্ঠাতা তাঁকে ঋত্বিক বলে। যজ্ঞের কাল নিরূপিত হত দিনের বেলায় শুক্লপক্ষ ও উত্তরায়ণকে লক্ষ্য করে। এই প্রসঙ্গে অহোরাত্র, পক্ষ, মাস, ঋতু, অয়ন, সংবৎসর গণনা করা ঋত্বিকের বিশেষ প্রয়োজন পড়ত। এই জন্যই জ্যোতিষের উদ্ভব হয়েছে।

লগধের বেদাঙ্গ জ্যোতিষ নামে একটি গ্রন্থ পাওয়া যায়। যাজুষ এবং আর্চভেদে তার দুটি শাখা আছে।

(৬) ষষ্ঠ বেদাঙ্গ হল কল্প। কল্পগুলি সূত্র আকারে গ্রথিত। তাতে যেমন যজ্ঞের প্রয়োগবিধি বর্ণিত আছে তেমন গার্হস্থ্য জীবনের সংস্কার প্রভৃতির আলোচনা আছে। এদের চারটি শ্রেণী আছেঃ শ্রৌতসূত্র, গৃহ্যসূত্র, ধর্মসূত্র ও শুল্কসুত্র।

ব্রাহ্মণে যে সমস্ত যজ্ঞের উল্লেখ আছে তাদের বলা হয় শৌত যজ্ঞ কারণ ব্রাহ্মণ শ্রুতির অঙ্গ। এই যজ্ঞগুলির সংখ্যা চৌদ্দটি - সাতটি হবির্যজ্ঞ অর্থাৎ ঘৃতাহুতি দিয়ে নিস্পন্ন করতে হয় এবং সাতটি সোম যজ্ঞ অর্থাৎ সোমরস আহুতি দিতে হয়। শ্রৌত সূত্রে এই চৌদ্দটি যজ্ঞের বিবরণ আছে। এর জন্য তিনটি অগ্নির আধান করতে হয়ঃ গার্হপত্য, আহবনীয় ও দক্ষিণ। এদের বিষয়েও আলোচনা আছে।

এই চৌদ্দটি যজ্ঞ ছাড়া আরও অতিরিক্ত যজ্ঞ আছে। তাদের 'স্মার্ত' যাগ বলা হয়। তাতে ঔপাসন, হোম, বৈশ্বদেব প্রভৃতি সাতটি যজ্ঞের বিধান আছে। এদের আলোচনা পাই গৃহ্যসূত্রে। স্মার্ত কর্মগুলি স্মার্ত অগ্নিতে করা নিয়ম। স্মার্ত অগ্নির অন্য নাম বৈবাহিক, গৃহ্য, অবিসথ্য ও ঔপাসন অগ্নি। কতকগুলি যজ্ঞের শ্রৌত এবং গৃহ্য উভয় রূপই আছে। যেমন অগ্নিহোত্র, দশপূর্ণমান, পশুযাগ, পিতৃযাগ।

হিন্দুর জীবনে জন্ম হতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্যন্ত যে দশটি সংস্কার পালন করতে হয় সে বিষয়ে আমরা অবহিত; কারণ বৈদিক যুগ হতে এগুলি এখনও পালিত হয়ে থাকে। যেমন জাতকর্ম, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চুড়াকরণ, কর্ণবেধ, উপনয়ন, সমাবর্তন, বিবাহ, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। এগুলি কিভাবে সম্পাদিত করতে হবে তার বিধি গৃহ্যসূত্রে আছে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে এই সংস্কারগুলি হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত আছে।

ধর্ম সূত্র পরিবারকে ছাড়িয়ে সমাজে পরিব্যাপ্ত। তাতে কর্তব্য অকর্তব্য, দেশাচার-লোকাচার প্রভৃতির বিষয়ে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এর আর এক নাম হল 'সাময়াচারিক সূত্র। এখানে সময় অর্থে বুঝতে হতে সর্বসম্মত অনুশাসন। সুতরাং তাতে আছে সর্বসম্মত অনুশাসন এবং আচরণ  সন্বন্ধে উপদেশ।

তারপর শূল্বসূত্র। তার সঙ্গে কল্পসূত্রের সংযোগ আছে। শুল্ব মানে জমি মাপবার দড়ি। তাতে নানা ধরনের যজ্ঞবেদির পরিমাণ ঠিক করবার নিয়ম দেওয়া আছে। সুতরাং শূল্বসূত্রের সঙ্গে তা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ঠিক বলতে কি এখানে ভারতীয় জ্যামিতিকে বীজ আকারে পাই।

প্রতি বেদের সঙ্গে সংযুক্ত নানা শ্রেণীর কল্পসূত্র পাওয়া যায়। তাদের একটি তালিকা নীচে দেওয়া হলঃ

ঋগবেদঃ
শ্রৌতসূত্রঃ শাংখ্যায়ন ব্রাহ্মণের সহিত সংযুক্ত শাংখ্যায়ন শ্রৌতসূত্র ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণের সঙ্গে সংযুক্ত আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র।
গৃহ্যসূত্রঃ শাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্র, আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র, শন্বিবৎ গৃহ্যসূত্র। ঋগবেদে ধর্মসুত্র বা শুল্কসূত্র নেই।

সামবেদঃ
শ্রৌতসূত্রঃ পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের সহিত যুক্ত মশক শ্রৌতসূত্র ও লাট্টায়ন শ্রৌতসূত্র, রাণায়নীয় শাখার দ্রাহ্যায়ণ শ্রৌতসূত্রঃ।
গৃহ্যসূত্রঃ গোভিল গৃহ্যসূত্র, রাণায়নীয় শাখার খাদির গৃহ্যসূত্র ও জৈমিনীয় শাখার জৈমিনীয় গৃহ্যসূত্র। ধর্মসুত্রঃ রাণায়নীয় শাকার গৌতম ধর্মসূত্র। সামবেদের কোন শুল্কসূত্র নেই।

কৃষ্ণ যজুর্বেদ
শ্রৌতসূত্রঃ তৈত্তিরীয় শাখায় দুটিঃ বৌধায়ন শ্রৌতসূত্র, বাধূল শ্রৌতসূত্র, ভারদ্বাজ শ্রৌতসূত্র, আপন্তন্ব শ্রৌতসূত্র, হিরণ্যকেশি শ্রৌতসূত্র, বৈখানস শ্রৌতসূত্র। কাঠক শাখায় কাঠক শ্রৌতসূত্র, মৈত্রায়ণী শাখার মানব শ্রৌতসূত্র এবং বারাহ শ্রৌতসূত্র।
গৃহ্যসূত্রঃ তৈত্তিরীয় শাখার বৌধায়ন, বাধূল, ভারদ্বাজ, আপস্তন্ব, হিরণ্যকেশি ও বৌখানস গৃহ্যসূত্র।
কাঠক শাখায় কাঠক গৃহ্যসূত্র। মৈত্রায়ণেয় শাকার মানব এবং বারাহ গৃহ্যসূত্র।
ধর্মসূত্রঃ তৈত্তিরীয় শাখায় বৌধায়ন, আপস্তন্ব, হিরণ্যকেশি এবং বৈখানস ধর্মসূত্র।
শুল্বসূত্রঃ তৈত্তিরীয় শাখায় বৌধায়ন, আপস্তন্ব ও হিরণ্যকেশি শুল্বসূত্র।

কাঠক শাখায় কাঠক শুল্বসূত্র। মৈত্রায়ণী শাখার মানব এবং বারাহ শুল্বসূত্র। শুল্ক যজুর্বেদঃ
শ্রৌতসূত্র - কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র
গৃহ্যসূত্র - পারস্ক্র গৃহ্যসূত্র
শূল্বসূত্র - কাত্যায়ন শূল্বসূত্র
শুক্ল যজুর্বেদে ধর্মসূত্র নেই।

অথর্ববেদঃ
শ্রৌতসূত্রঃ বৈতান শ্রৌতসূত্র।
গৃহ্যসূত্রঃ কৌশিক গৃহ্যসূত্র।

এগুলি অন্য বেদের সূত্রের মত নয়। কৌশিকসূত্রে অনেক তুকতাকের কথা আছে। অথর্ববেদে ধর্মসূত্র ও শুল্বসূত নেই।

1 comment:

  1. নমস্কার। অন্তর্জালে ঘুরতে ঘুরতে আপনার ব্লগের সন্ধান পেলাম। আপনার প্রচেষ্টা সফল হউক। এই ব্লগে আপনি যে তথ্যগুলো উপস্থাপন করেছেন তা কি আপনি সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করেছেন? নাকি অন্যকারও অনুবাদিত তথ্য উপস্থান করেছেন মাত্র। যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে অনুগ্রহপূর্বক গ্রন্থের তথ্যসূত্র উল্লেখ করুন। এতে করে অন্য কোথায় তর্কে ও আলোচনায় তথ্যসূত্র উপস্থাপন করতে সুবিধা হবে।

    ReplyDelete