Tuesday, August 30, 2011

ঋগবেদ-সংহিতা : প্রথম মন্ডল : ৮ সূক্ত

ইন্দ্র দেবতাঃ। বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা ঋষি। গায়ত্রী ছন্দ।

সূক্ত - এন্দ্র সানসিৎ রয়িং সজিত্বানং সদাসহং। বর্ষিষ্ঠমূতয়ে ভর।।১।।
অনুবাদ : ।।১।। হে ইন্দ্র! আমাদের রক্ষণার্থে সম্ভোগযোগ্য, জয়শীল, সদা শত্রুবিজয়ী ও প্রভূত ধন দাও।

সূক্ত - নি যেন মুষ্টিহত্যয়া নি বৃত্রা রুণধামহৈ। ত্বোতাসো ন্যর্বতা।।২।।
অনুবাদ : ।।২।। যে ধনদ্বারা (নিযুক্তি সৈন্যদিগের) নিরন্তর মুষ্টিপ্রহার দ্বারা আমরা শত্রুকে নিবারণ করব অথবা তোমার দ্বারা রক্ষিত হয়ে অশ্ব দ্বারা শত্রুকে নিবারণ করব।

সূক্ত - ইন্দ্র ত্বোতাস আ বয়ং বজ্রং ঘনা দদীমহি। জয়েমসং যুধি স্পৃধঃ।।৩
অনুবাদ : ।।৩।। হে ইন্দ্র! তোমার দ্বারা রক্ষিত হয়ে আমরা কঠিন অস্ত্র ধারণ করি, যুদ্ধে স্পর্দ্ধাযুক্ত শত্রুকে জয় করব।

সূক্ত - বয়ং শূরেভিরস্তৃভিরিন্দ্র ত্বয়া যুজা বয়ং। সাসহ্যাম পৃতন্যতঃ।।৪
অনুবাদ : ।।৪।। হে ইন্দ্র! তোমার সহায়তায় আমরা বীর অস্ত্রধারীদের সাথে সৈন্যসজ্জাযুক্ত শত্রুকেও পরাভব করতে পারি।

সূক্ত - মহাঁ ইন্দ্রঃ পরশ্চ নু মহিত্বমস্তু বজ্রিণে। দ্যৌর্ন প্রথিনা শবঃ।।৫
অনুবাদ : ।।৫।। ইন্দ্র মহৎ এবং সর্বোৎকৃষ্ট, বজ্রধারী ইন্দ্রে মহত্ত্ব অবস্থিতি করুক; তাঁর সৈন্য আকাশের ন্যায় প্রভূত।

সূক্ত - সমোহে বা য আশত নরস্তোকস্য সনিতৌ। বিপ্রাসো ব ধিয়াযবঃ।।৬
অনুবাদ : ।।৬।। যে পুরুষেরা সংগ্রামে লিপ্ত হন, অথবা পুত্র লাভ ইচ্ছা করেন অথবা যে বিজ্ঞ লোকেরা জ্ঞানাকাঙ্খায় থাকেন (তাঁরা সকলেই ইন্দ্রের স্তুতি দ্বারা সিদ্ধি লাভ করেন)।

সূক্ত - যঃ কুক্ষিঃ সোমপাতমঃ সমুদ্র ইব পিন্বতে। উর্বীরাপো ন কাকুদঃ ।।৭
অনুবাদ : ।।৭।। ইন্দ্রের যে উদরদেশ অতিশয় সোমরসপানে তৎপর সে উদর সমুদ্রের ন্যায় স্ফীত হয়, মুখের প্রচুর জলের ন্যায় (কখনও শুস্ক হয় না)।

সূক্ত - এবা হ্যস্য সূনৃতা বিরপ্ শী গোমতী মহী। পক্বা শাখা ন দাশুষে।।৮
অনুবাদ : ।।৮।। ইন্দ্রের সুনৃত বাক্য প্রকৃতই সুনৃত এবং বিবিধ (মিষ্ট) বচনযুক্ত, সে বাক্য মহৎ এবং গাভীদান করে; এবং হব্যদাতার পক্ষে সে বাক্য পরিপক্ক ফলপূর্ণ শাখার ন্যায়।

সূক্ত - এবা হি তে বিভূতয় উতয় ইন্দ্র মাবতে। সদ্যশ্চিৎসন্তি দাশুষে।।।৯
অনুবাদ : ।।৯।। হে ইন্দ্র! তোমার ঐশ্বর্য প্রকৃতই এরূপ, এবং আমার মত হব্যদাতার রক্ষণের হেতু, এবং তৎক্ষণফলদায়ী।

সূক্ত - এবা হ্যস্য কাম্যা স্তোম উক্ থং শংস্যা। ইন্দ্রায়া সোমপীতয়ে।।১০
অনুবাদ : ।।১০।। তাঁর স্তোম ও উক্ থ প্রকৃতই এরূপ, অর্থাৎ কাম্য, এবং ইন্দ্রের সোমপানের জন্য কথনীয়।

ঋগবেদ-সংহিতা : প্রথম মন্ডল : ৭ সূক্ত

ইন্দ্র দেবতাঃ। বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা ঋষি। গায়ত্রী ছন্দ।

সূক্ত - ইন্দ্র মিদ্ গাথিনো বৃহদিন্দ্রমর্কেভিরর্কিণঃ। ইন্দ্রং বাণীরনূষত।।১।।
অনুবাদ : ।।১।। গাথাকারেরা বৃহৎ গাথা দ্বারা, অর্কীগণ অর্ক দ্বারা বাণীকারেরা বাণীদ্বারা ইন্দ্রকে স্তুতি করেছেন।

সূক্ত - ইন্দ্র ইদ্ধর্যোঃ সচা সংমিশ্ল বচোযুজা। ইন্দ্রো বজ্রী হিরণ্যয়ঃ।।২।।
অনুবাদ : ।।২।। ইন্দ্র হরিদ্বয়কে বচনমাত্রে যোজিত করে সকলের সাথে মিশছেন, তিনি বজ্রযুক্ত ও হিরন্ময়। 

সূক্ত - ইন্দ্রো দীর্ঘায় চক্ষস আ সূর্যং রোহয়দ্দিবি। বি গোভিরদ্রিমৈরয়ত্।।৩
অনুবাদ : ।।৩।। ইন্দ্র বহুদূর দর্শনের জন্য আকাশে সূর্যকে আরোহণ করিয়েছিলেন; সূর্য কিরণ দ্বারা পর্বত আলোকিত করেছেন। 

সূক্ত - ইন্দ্র বাজেষু নোহব সহস্রপ্রধনেষু চ। উগ্র তগ্রাভিরুতিভিঃ।।৪
অনুবাদ : ।।৪।। হে উগ্র ইন্দ্র! তোমার অমোঘ রক্ষণাবেক্ষণ দ্বারা আহবে এবং (গজাশ্বাদি) লাভযুক্ত সহস্র মহাযুদ্ধে আমাদের রক্ষা কর।

সূক্ত - ইন্দ্রং বয়ং মহাধন ইন্দ্রমর্ভে হবামহে। যুজং বৃত্রেষে বজ্রিণম্।।৫
অনুবাদ : ।।৫।। ইন্দ্র আমাদের সহায় এবং শত্রুদের পক্ষে বজ্রধারী আমরা মহাধনের জন্য এবং স্বল্প ধনের জন্যও জন্য ইন্দ্রকে আহ্বান করি।   

সূক্ত - স নো বৃষন্নমূং চরুং সত্রাদাবন্নপা বৃধি। অস্মভ্যমপ্রতিস্কুতঃ।।৬
অনুবাদ : ।।৬।। হে সর্বফলদাতা, হে বৃষ্টিপ্রদ ইন্দ্র তুমি আমাদের জন্য ঐ মেঘ উদ্ঘাটন করে দাও; তুমি আমাদের যাঙ্ঞা কখনও অগ্রাহ্য কর নি।

সূক্ত - তুঞ্জেতুঞ্জে য উত্তরে স্তোতা ইন্দ্রস্য বজ্রিণঃ। ন বিন্ধে অস্য সুষ্টুতিম্য।।৭
অনুবাদ : ।।৭।। ভিন্ন ভিন্ন ফলদাতা ভিন্ন ভিন্ন দেবতা সন্বন্ধে যে স্তুতিবাক্য প্রয়োগ উৎকৃষ্ট হয়, সে সমস্ত স্তোমই বজ্রধারী ইন্দ্রের; তাঁর যোগ্য স্তুতি আমি জানি না।

সূক্ত - বৃষা যূথেব বংসগঃ কৃষ্টীরিষর্ত্যোজসা। ঈশানো অপ্রতিস্কুতঃ।।৮
অনুবাদ : ।।৮।। যেরূপ বননীয়গতি বৃষভযূথকে বলপূর্ণ করে অভীষ্টবর্ষী ইন্দ্র সেরূপ মনুষ্যদের বলপূর্ণ করেন; ইন্দ্র ক্ষমতাশালী ও যাঙ্ঞা অগ্রাহ্য করেন না।

সূক্ত - স একশ্চর্ষণীনাং বসূনামিরজ্যতি। ইন্দ্রঃ পঞ্চ ক্ষিতীনাম্।।৯
অনুবাদ : ।।৯।। যে ইন্দ্র একাকী মনুষ্যদের ধন সমূহের এবং পঞ্চক্ষিতির (১) উপর শাসন করেন।

সূক্ত - ইন্দ্রং বো বিশ্বতস্পরি হবামহে জনেভ্যঃ। অস্মাকমস্ত কেবলঃ।।১০
অনুবাদ : ।।১০।। সর্বজনের উপরিস্থিতি ইন্দ্রকে তোমাদের জন্য আহ্বান করি, তিনি কেবল আমাদেরই হোন।



টিকাঃ- 'পঞ্চক্ষিতি' = ঋগ্বেদে 'পঞ্চক্ষিতি' বা 'পঞ্চকৃষ্টি' বা 'পঞ্চজন' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তার অর্থ পাঞ্জাব প্রদেশ ও পঞ্চনদকূলবাসী সমস্ত আর্য জাতি।

ঋগবেদ-সংহিতা : প্রথম মন্ডল : ৬ সূক্ত

ইন্দ্র দেবতাঃ। বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা ঋষি। গায়ত্রী ছন্দ।

সূক্ত - যুঞ্জন্তি ব্র্ধ্মমরুষং চরন্তং পরি তস্থুষঃ। রোচন্তে রোচনা দিবি।।১।।
অনুবাদ : ।।১।। চারদিকের লোকেরা সূর্যরূপ ইন্দ্রের প্রতাপান্বিত, অরুষ ও বিচরণকারী অশ্ব যোজনা করছে। আলোকগণ আকাশে দীপ্যমান রয়েছে(১)।

সূক্ত - যুঞ্জন্ত্যস্য কাম্যা হরী বিপক্ষসা রথে। শোনা ধৃষ্ণ্ নৃবাহসা।।২।।
অনুবাদ : ।।২।। তারা ইন্দ্রের কমনীয়, রক্তবর্ণ, তেজঃপূর্ণ ও পুরুষবাহক হরি নামক অশ্বদ্বয় রথের উভয় পার্শ্বে সংযোজিত করে।

সূক্ত - কেতুং কৃন্বন্নকেতবে পেশো মর্ষা অপেশসে। সমুষদ্ভিরজায়থাঃ।।৩
অনুবাদ : ।।৩।। হে মনুষ্যগণ! সূর্যরূপ ইন্দ্র নিদ্রায়া সংজ্ঞারহিতকে সংজ্ঞাদান করে, অন্ধকারে রূপরহিতকে রূপ দান করে, জলন্ত রশ্মির সাথে উদিত হন।

সূক্ত - আদহ স্বধামনু পূনর্গভত্বমেরিরে। দধানা নাম যজ্ঞিয়ম্।।৪
অনুবাদ : ।।৪।। তারপর মরুৎগণ (২) যজ্ঞার্হ নাম ধারণ করে স্বীয় প্রকৃতি অনুসারে মেঘের মধ্যে জলের গর্ভাকার রচনা করলেন।

সূক্ত - বীলু চিদারূজত্বুভির্গুহা চিদিন্দ্র বহ্নিভিঃ। অবিন্দ উস্রিয়া অনু।।৫
অনুবাদ : ।।৫।। হে ইন্দ্র! দৃঢ় স্থানের ভেদকারী এবং বহনশীল মরুৎদের সাথে তুমি গুহায় লুকান গাভী সমুদয় অন্বেষণ করে উদ্ধার করেছিলে (৩)।  

সূক্ত - দেবযন্তো যথা মতিমচ্ছা বিদদ্বসুং গিরঃ। মহামনূষত শ্রুতম্।।৬
অনুবাদ : ।।৬।। স্তোতাগণ দেবতা কামনা করে ধনযুক্ত ও মহৎ ও বিখ্যাত মরুৎগণকে লক্ষ্য করে সুমন্ত্রী ইন্দ্রের ন্যায় স্তুতি করে।

সূক্ত - ইন্দ্রেণ সং হি দৃক্ষসে সংজগ্মানো অবিভ্যুষা। মন্দূ সমানবর্চসা।।৭
অনুবাদ : ।।৭।। হে মরুৎগণ! যেন তোমাদের ভীতিরহিত ইন্দ্রের সঙ্গে মিলিত দেখা যায়; তোমরা নিত্য প্রমুদিত ও তুল্যদীপ্তি বিশিষ্ট।

সূক্ত - অনবদ্যৈরভিদ্যুভির্মখঃ সহস্বদর্চতি। গণৈরিন্দ্রসা কাম্যৈঃ।।৮
অনুবাদ : ।।৮।। দোষ রহিত, স্বর্গাভিগত ও কাময়িতব্য মরুৎগণের সাথে ইন্দ্রকে বলসম্পন্ন বলে এ যজ্ঞ অর্চনা করছে।

সূক্ত - অতঃ পরিঙ্মন্না গহি দিবো বা রোচনাদধি। সমস্মিন্নুঞ্জতে গিরঃ।।৯
অনুবাদ : ।।৯।। হে চতুর্দিকব্যাপী মরুৎগণ! ঐ অন্তরিক্ষ হতে অথবা আকাশ হতে, অথবা দীপ্যমান আদিত্যমন্ডল হতে এস; এ যজ্ঞে ঋত্বিক সম্যকরূপে স্তুতি সাধন করছে।

সূক্ত - ইতো বা সাতিমীমহে দিবো বা পার্থিবাদধি। ইন্দ্রং মহো বা রজসঃ।।১০
অনুবাদ : ।।১০।। এ পৃথিবী হতে অথবা আকাশ হতে অথবা মহৎ অন্তরিক্ষ হতে ধন দানের জন্য ইন্দ্রের নিকট যাঙঞা করি।

টীকাঃ-
১। এ ঋকের অর্থ অপরিস্কার। যথা মূলে 'অরুষ' শব্দ আছে, সায়ণ তার অর্থ করেছেন 'হিংসক রহিত'। পন্ডিত মক্ষমূলর বলেন 'অরুষের' আদি অর্থ লোহিতবর্ণ এবং অরুষ বিশেষ্য হয়ে ব্যবহৃত হলে সূর্যের একটি অশ্বের নাম। তিনি আরও বলেন, এ সূর্যের লোহিত বর্ণ অশ্ব 'অরুষ' গ্রীসদেশে রূপান্তর প্রাপ্ত হয়ে 'Eros' নাম ধারণ করে প্রেমের দেবতা বলে পূজিত হতেন! - Chips from a German Workshop. সূর্যের অশ্বগণের সাধারণ নাম হরিৎ সেজন্য সূর্যকে হরিদশ্ব বলে। মক্ষমূলর বিবেচনা করেন এ 'হরিৎ'গণ গ্রীসদেশে রূপান্তর প্রাপ্ত হয়ে Charites নামক ধারন করে পরম রূপবতী ও কমনীয় দেবীরূপে পূজিত হতেন। - Science of Language. 
২। মরুৎগণ কে? মরুৎ শব্দ "মৃ" ধাতু হতে উৎপন্ন, সে ধাতুর অর্থ আঘাত করা বাঁ হনন করা। মরুৎগণ আঘাতকারী বা ধ্বংসকর ঝড়বায়ু। ঐ ধাতু হতে লাটিনদের যুদ্ধদেব Mars ঐ নাম পেয়েছেন।
৩। পণিঃ নামক অসুরেরা দেবলোক হতে গাভী অপহরণ করে অন্ধকারে রেখেছিল, ইন্দ্র মরুৎদের সাথে তা উদ্ধার করেছিলেন। গাভীর অন্বেষণার্থ সরমা নাম্নী এক দেব কুক্কুরীকে নিযুক্ত করেছিলেন, এবং সরমা অসুরদের সাথে বন্ধুত্ব করে গাভীর অনুসন্ধান পেয়েছিল। সায়ণ। ইউরোপীয় পন্ডিত মক্ষমূলর বিবেচনা করেন এ বৈদিক উপাখ্যানটি প্রাতঃকালে প্রকৃতি সন্বন্ধীয় একটি উপমা মাত্র। তিনি বলেন, সরমা ঊষার একটি নাম। দেবগণের গাভীগণ অর্থাৎ সূর্যরশ্মি সমুদয় অন্ধকার দ্বারা অপহৃত হয়েছে। দেবগণ ও মানুষেরা তাদের উদ্ধারের জন্য ব্যস্ত হয়েছেন। অবশেষে ঊষা দেখা দিলেন। তিনি বিদ্যুৎগতিতে, গন্ধ পেয় কুক্কুরী যেরূপ যায় সেরূপ ইতস্ততঃ ধাবমান হতে লাগলেন। তিনি সন্ধান নিয়ে ফিরে এলে আলোকদেব ইন্দ্র প্রকাশ হয়ে অন্ধকারের সাথে যুদ্ধ করলেন এবং তাদের দূর্গ হতে সে দেবগাভী উদ্ধার করলেন। মক্ষমূলর আরও বিবেচনা করেন ট্রয়ের যুদ্ধের যে গল্প নিয়ে চিরস্মরিণীয় কবি হোমর গ্রীক ভাষায় মহাকাব্য লিখেছেন, সে গল্প এই পণিঃ ও সরমার গল্পের রূপান্তর মাত্র। 'The siege of Troy is but a repetition of the daily siege of the East, by the solar powers that every evenings are robbed of their brightest treasures in the west." - Science of Language.

Friday, August 26, 2011

ঋগবেদ-সংহিতা : প্রথম মন্ডল : ৫ সূক্ত


ইন্দ্র দেবতাঃ। বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা ঋষি। গায়ত্রী ছন্দ।

সূক্ত - আ ত্বেতা নি ষীদতেন্দ্রমভি প্র গায়ত। সখায়ঃ স্তোমবাহসঃ।।১।।
অনুবাদ : ।।১।। হে স্তুতিবাদক সখাগণ! শীঘ্র এস, উপবেশন কর, ইন্দ্রকে লক্ষ্য করে গাও।

সূক্ত - পুরূতমং পুরূণামীশানং বার্যানাং। ইন্দ্রং সোমে সচা সুতে।।২।।
অনুবাদ : ।।২।। এ সোমরস অভিষুত হলে সকলে একত্র হয়ে বহু শত্রুর দমনকারী, বহু বরণীয় ধনের স্বামী ইন্দ্রকে লক্ষ্য করে গাও।

সূক্ত - স ঘা নো যোগ আ ভুতত্ স রাযে স পুরন্ধ্যাং। গমদ্বাজেভিরা স নঃ।।৩
অনুবাদ : ।।৩।। তিনি আমাদের উদ্দেশ্য সাধন করুন, তিনি ধন প্রদান করুন, তিনি স্ত্রী প্রদান করুন, তিনি অন্ন নিয়ে আমাদের নিকটে আগমন করুন।

সূক্ত - যন্য সংস্থে ন বৃন্বতে হরী সমৎসু শত্রবঃ। তস্মা ইন্দ্রায় গায়ত।।৪
অনুবাদ : ।।৪।। যুদ্ধে শত্রুরা যাঁর রথযুক্ত অশ্বদ্বয়ের সম্মুখীন হতে পারে না, সে ইন্দ্রকে লক্ষ্য করে গাও।

সূক্ত - সুতপাব্নে সুতা ইমে শুচয়ো যন্তি বীতয়ে। সোমাসো দধ্যাশিরঃ।।৫
অনুবাদ : ।।৫।। এ অভিষুত পবিত্র, দধিমিশ্রিত সোমরস সমূহ অভিষুত সোমপায়ীর পানার্থ তাঁর নিকট যাচ্ছে।  

সূক্ত - ত্বং সুতস্য পীতয়ে সদ্যো বৃদ্ধো অজায়থাঃ। ইন্দ্র জৈষ্ঠ্যায় সুক্রতো।।৬
অনুবাদ : ।।৬।। হে সুক্রতু ইন্দ্র! তুমি অভিষুত সোম পানের জন্য ও দেবগণের মধ্যে জ্যেষ্ঠত্ব প্রাপ্তির জন্য একেবারেই বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছ।

সূক্ত - আ ত্বাঃ বিশন্ত্বাশবঃ সোমাস ইন্দ্র গির্বণঃ। শন্তে সন্তু প্রচেতসে।।৭
অনুবাদ : ।।৭।। হে স্তুতিভাজন ইন্দ্র! ব্যাপনশীল অর্থাৎ শীঘ্রমাদক সোমরস সমূহ তোমাতে প্রবেশ করুক, প্রকৃষ্ট জ্ঞানলাভে তোমার মঙ্গলকারী হোক।

সূক্ত - ত্বাং স্তোমা অবীবৃধন্ত্বামুক্ থা শতক্রতো। ত্বাং বর্ধন্তু নো গিরঃ।।৮
অনুবাদ : ।।৮।। হে শতক্রতু। স্তোম সমূহ তোমাকে বর্ধন করেছে, উক্ থ সমূহ তোমাকে বর্ধন করেছে, আমাদের স্তুতি তোমাকে বর্ধন করুক।

সূক্ত - অক্ষিতোতিঃ সনেদিমং বাজমিন্দ্রঃ সহস্রিণং। যস্মিন্বিশ্বানি পৌংস্যা।।৯
অনুবাদ : ।।৯।। ইন্দ্র রক্ষণে বিরত না হয়ে এ সহস্রসংখ্যক অন্ন গ্রহণ করুন, যে অন্নে সমস্ত পৌরুষ অবস্থিতি করে।

সূক্ত - মা নো মর্তা অভি দ্রুহন্তনূনামিন্দ্র গির্বণঃ। ঈশানো যবয়া বধম্।।১০
অনুবাদ : ।।১০।। হে স্তুতিভাজন ইন্দ্র! বিরোধী মনুষ্যেরা আমাদের শোরীরে যেন আঘাত না করে, তুমি ক্ষমতাশালী, আমাদের বধ নিবারণ কর।

Wednesday, August 24, 2011

ঋগবেদ-সংহিতা : প্রথম মন্ডল : ৪ সূক্ত


ইন্দ্র দেবতাঃ। বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা ঋষি। গায়ত্রী ছন্দ।

সূক্ত - সুরুপকৃত্বমূতয়ে সুদুঘামিব গোদুহে। জুহূমসি দ্যবিদ্যবি।।১।।
অনুবাদ : ।।১।। যেরূপ দোহক দোহন হেতু সুদুগ্ধবতী গাভীকে আহ্বান করে, আমরাও সেরূপ রক্ষার্থে দিনে দিনে শোভনকর্মা ইন্দ্রকে আহ্বান করি।

সূক্ত - উপঃ নঃ সবনা গহি সোমস্য সোমপাঃ পিব। নোদা ইদ্রেবতো মদঃ।।২।।
অনুবাদ : ।।২।। হে সোমপায়ী ইন্দ্র ! আমাদের অভিষবের নিকট এস, সোমপান কর; তুমি ধনবান তুমি হৃষ্ট হলে গাভী দান কর।

সূক্ত - অথা তে অন্তমানাং বিদ্যাম সুমদীনাং। মা নো অতি খ্য অ গহি।।৩
অনুবাদ : ।।৩।। আমরা যেন তোমার সমীপবর্তী সুমতিদের মধ্যে থেকে তোমাকে জানতে পারি; আমাদের অতিক্রম করে অন্যের মধ্যে আপনাকে প্রকাশ করো না; আমাদের নিকট এস।

সূক্ত - পরেহি বিগ্রমস্তৃতমিন্দ্রং পৃচ্ছা বিপশ্চিতং। যন্তে সখিভ্য আ বরম্।।৪
অনুবাদ : ।।৪।। অজেয় ও মেধাবী ইন্দ্রের সমীপে যাও। এ মেধাবীর কথা জিজ্ঞাসা কর; সে ইন্দ্র তোমার বন্ধুদের শ্রেষ্ঠ ধন দান করেন।

সূক্ত - উত ব্রুবন্তু নো নিদো নিরন্যশ্চিদারত। দধানা ইন্দ্র ইন্দুবঃ।।৫
অনুবাদ : ।।৫।। আমাদের ঋত্বিকেরা ইন্দ্রের পরিচর্যা করে তাঁকে স্তুতি করুন। হে নিন্দুকগণ! এ দেশ হতে এবং অন্য দেশ হতেও দূর হয়ে যাও।  

সূক্ত - উত নঃ সুভগাঁ অরির্বোচেয়ুর্দস্ম কৃষ্টয়ঃ। স্যামেন্দ্রস্য শর্মণি।।৬
অনুবাদ : ।।৬।। হে শত্রুক্ষয়কারক! শত্রুও যেন আমাদের সৌভাগ্যশালী বলে; আমাদের মিত্রপক্ষীয় মনুষ্যেরা (১) ত বলবেই; যেন আমরা ইন্দ্রের প্রসাদলব্ধ সুখে বাস করি।

সূক্ত - এমাশুমাশবে ভর যজ্ঞশ্রিয়ং নৃমাদনং। পতয়ন্মন্দ্রয়ত্ সখং।।৭
অনুবাদ : ।।৭।। এ সোমরস ব্যাপনশীল ও যজ্ঞের সম্পদ্ রূপ, এ মানুষকে হৃষ্ট করে, কার্যসাধন করে এবং হর্ষদাতা ইন্দ্রের সখা; যজ্ঞব্যাপী ইন্দ্রকে এ দান কর।

সূক্ত - অস্য পীত্বা শতক্রতো ঘনো কৃত্রাণামভবঃ। প্রাবো বাজেষু বাজিনম্।।৮
অনুবাদ : ।।৮।। হে শতক্রতু! এ সোমপান করে তুমি বৃত্র প্রভৃতি শত্রুদের হনন করেছিলে, যুদ্ধে (তোমার ভক্ত) যোদ্ধাদের রক্ষা করেছিলে।

সূক্ত - তং ত্বা বাজেষু বাজিনং বাজয়ামঃ শতক্রতো। ধনানামিন্দ্র সাতয়ে।।৯
অনুবাদ : ।।৯।। হে শতক্রতু! তুমি সে যোদ্ধা! হে ইন্দ্র! ধনলাভার্থ তোমাকে অন্নবান্ করি।

Saturday, August 20, 2011

ঋগবেদ-সংহিতা : প্রথম মন্ডল : ৩ সূক্ত

অশ্বিদ্বয় প্রভৃতি দেবতাঃ। বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা ঋষি। গায়ত্রী ছন্দ।
সূক্ত - অশ্বিনা যজ্বরীরিষো দ্রবৎপাণী শুভস্পতী। পুরুভুজা চনস্যতম্।।১।।
অনুবাদ : ।।১।। হে ক্ষিপ্রপাণি, শুভকর্মপালক, বিস্তীর্ণ ভুজ বিশিষ্ট অশ্বিদ্বয় (১)! তোমরা যজ্ঞের অন্ন কামনা কর।

সূক্ত - অশ্বিনা পুরুদংসসা নরা শবীরয়া ধিয়া। ধিষ্ণ্যা বনতং গিরঃ।।২।।
অনুবাদ : ।।২।। হে বহুকর্মা, নেতা, ও বিক্রমশালী অশ্বিদ্বয়! অপ্রতিহত বুদ্ধির সঙ্গে আমাদের স্তুতি গ্রহণ কর।

সূক্ত - দস্রা যুবাকরঃ সুতা র্নাসত্যা বৃক্তবর্হিষঃ। আ যাতং রুদ্রবর্তনী।।৩
অনুবাদ : ।।৩।। হে দস্রদ্বয়! হে নাসত্যদ্বয় (২)! হে রুদ্রবর্ত্মন অশ্বিদ্বয়! মিশ্রিত সোমরস অভিষুত হয়েছে, ছিন্ন কুশে স্থাপিত হয়েছে, তোমরা এস।

সূক্ত - ইন্দ্রা যাহি চিত্রভানো সূতা ইমে ত্বায়বঃ। অন্বীভিস্তনা পূতাসঃ।।৪
অনুবাদ : ।।৪।। হে বিচিত্র দীপ্তিবিশিষ্ট ইন্দ্র! আঙুল দিয়ে অভিষুত নিত্যশুদ্ধ এ (সোমরস) তোমাকে কামনা করছে, তুমি এস।

সূক্ত - ইন্দ্রা যাহি ধিয়েষিতো বিপ্রজূতঃ সুতাবতঃ। উপ ব্রহ্মাণি বাঘতঃ।।৫
অনুবাদ : ।।৫।। হে ইন্দ্র! আমাদের ভক্তিদ্বারা আকৃষ্ট হয়ে, মেধাবীদের দ্বারা আহূত হয়ে অভিষবকারী ঋত্বিকের স্তোত্র গ্রহণ করতে এস। 

সূক্ত - ইন্দ্রা যাহি তুতুজান উপ ব্রহ্মাণি হরিবঃ। সুতে দধিষ্ব নশ্চনঃ ।।৬
অনুবাদ : ।।৬।। হে অশ্বযুক্ত ইন্দ্র! তরান্বিত হয়ে স্তোত্র গ্রহণ করতে এস; এ সোমাভিষবযুক্ত যজ্ঞে আমাদের ধারণ কর।

- ওমাসশ্চর্ষণীধৃতো বিশ্বে দেবাস আ গত। দাশ্বাংসো দাশুষঃ সূতম।।৭
অনুবাদ : ।।৭।। হে বিশ্বদেবগণ (৩)! তোমরা রক্ষক, মনুষ্যগণের পালক, তোমরা হব্যদাতা যজমানের অভিষুত সোম গ্রহণ করতে এস; তোমরাই যজ্ঞের ফলদাতা।

সূক্ত - বিশ্বে দেবাসো অপ্তুরঃ সুতমা গন্ত তুর্ণয়ঃ। উস্রা ইব স্বসরাণি।।৮
অনুবাদ : ।।৮।। যেরূপ সূর্যরশ্মি দিনে আসে, বৃষ্টিদাতা বিশ্বদেবগণ ত্বরান্বিত হয়ে সেরূপ অভিষুত সোমরসে আগমন করুন।

- বিশ্বে দেবাসো অস্রিধ এহিমায়াসো অদ্রূহঃ। মেধাং জুষন্ত বহ্নয়ঃ।।৯
অনুবাদ : ।।৯।। বিশ্বদেবগণ ক্ষয়রহিত ও সদা বর্তমান; তাঁরা অকল্যাণরহিত ও ধনবাহক; তাঁরা যেন ও যজ্ঞ সেবন করেন।

- পাবকা নঃ সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী। যজ্ঞং বষ্টু ধিয়াবসুঃ।।১০
অনুবাদ : ।।১০।। পবিত্রা, অন্নযুক্তযজ্ঞবিশিষ্টা, ও যজ্ঞফলরূপধনদাত্রী সরস্বতী (৪) আমাদের অন্নবিশিষ্ট যজ্ঞ কামনা করুন।

- চোদয়িত্রী সূনৃতানাং চেতন্তী সুমতীনাং। যজ্ঞং দধে সরস্বতী।।১১
অনুবাদ : ।।১১।। সুনৃত বাক্যের উৎপাদয়িত্রী, সুমতি লোকদের শিক্ষয়িত্রী সরস্বতী আমাদের যজ্ঞ গ্রহণ করেছেন।

- মহো অর্ণঃ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা। ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি।।১২
অনুবাদ : ।।১২।। সরস্বতী প্রবাহিত হয়ে প্রভূত জল সৃজন করেছেন, এবং সকল জ্ঞান উদ্দীপন করেছেন।

টীকাঃ-
১। প্রকৃতির কোন্ দৃশ্যকে অশ্বিদ্বয় নাম দিয়ে প্রাচীন হিন্দুগণ উপাসনা করতেন? যাস্ক নিরুক্ততে সে বিষয়ে লিখেছেন "তৎ কৌ অশ্বিনৌ। দ্যাবা-পৃথিব্যৌ ইতি একে, অহোরাত্রৌ ইতি একে, সূর্যাচন্দ্রমসৌ ইতি একে। রাজানৌ পুণ্যকৃতোঁ ইতি ঐতিহাসিকাঃ।" যাস্কের নিজের মত যতদূর বুঝা যায় বোধ হয় অর্ধরাত্রির পর ও প্রাতঃকালের পূর্বে যে আলোক ও অন্ধকারে বিজড়িত থাকে তাই অশ্বিদ্বয়। ঊষার পূর্বে মিশ্রিত আলোক ও অন্ধকার যদি যমজদেব বলে উপাসিত হন তবে তাঁদের অশ্বী নাম দেওয়া হল কেন? এটি একটি বৈদিক উপমা মাত্র। সূর্যের আলোক আকাশে ধাবমান হয়, ঊষার আলোক আকাশে ধাবমান হয়, সে জন্য সে আলোক বাঁ রশ্মি সমূহকে ঋগ্বেদে সর্বদাই অশ্বি বলে বর্ণনা করা হয়েছে, এবং সূর্য ও ঊষাকে অশ্বযুক্ত বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অশ্বিন্ শব্দেরও সেই অর্থ, অশ্বযুক্ত অর্থাৎ আলোকযুক্ত।

২। "দস্রা। শত্রুণামুপক্ষয়িতারৌ যদ্বা দেববৈদ্যত্বেন রোগাণামুপক্ষয়িতারৌ। অশ্বিনৌ বৈ দেবানাং ভীষজৌ ইতি শ্রুতেঃ।" সয়ণ। "নাসত্যা। অসত্যমনৃতভাষণং। তদ্রহিতৌ।" সায়ণ। দস্রা ও নাসত্য এ দুটি শব্দ সর্বদাই অশ্বিদ্বয় সন্বন্ধে প্রয়োগ হয়।

৩। "বিশ্বেদেবাস এতন্নামকা দেববিশেষাঃ!" সায়ণ।

৪। সরঃ অর্থ জল, সরস্বতীর প্রথম অর্থ নদী এতে সন্দেহ নেই; আর্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে তাই প্রথমে সরস্বতী দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন। এক্ষণে গঙ্গা যেরূপ হিন্দুদের উপাস্যা দেবী, প্রথম হিন্দুদের পক্ষে সরস্বতী সেরূপ ছিলেন। অচিরে সরস্বতী বাগ্দেবীও হলেন। যাস্ক বলেছেন "তত্র সরস্বতী ইতি এতস্য নদীবদ্বেতাবচ্চ নিগমা ভবন্তি।" মূল ঋগ্বেদেও সরস্বতীর উভয় প্রকার গুণ লক্ষিত হয়। পুরাকালে সরস্বতী নদীতীরে যজ্ঞ সম্পাদন হত এবং মন্ত্র উচ্চারিত হত, ক্রমে সে সরস্বতী নদী সে পবিত্র মন্ত্রের দেবী ও বাগ্দেবী বলে পরিণত হলেন।

Friday, August 19, 2011

ঋগবেদ-সংহিতা : প্রথম মন্ডল : ২ সূক্ত

বায়ু প্রাভৃতি দেবতা। বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা ঋষি। গায়ত্রী ছন্দ।

সূক্ত - বায়বা যাহি দর্শতেমে সোমা অরংকৃতাঃ। তেষ্যং পাহি শ্রুধী হবম্।।১।।
অনুবাদ : ।।১।। হে দর্শনীয় বায়ু (১) এন, এ সোমরস সমূহ (২) অভিষুত হয়েছে; এ পান কর, আমাদের আহ্বান শ্রবণ কর।

সূক্ত - বায় উক্ থের্ভিজরন্তে ত্বামচ্ছা জরিতারঃ। সুতসোমা অহর্বিদঃ।।২।।
অনুবাদ : ।।২।। হে বায়ু! যজ্ঞাভিজ্ঞ স্তোতাগণ সোমরস অভিষুত করে তোমার উদ্দেশ্যে স্তুতিবাক্য প্রয়োগ স্তব করছে।

সূক্ত - বায়ো তব প্রপৃঞ্চতী ধেনা জিগাতি দাশুষে। উরুচী সোমপীতয়ে।।৩
অনুবাদ : ।।৩।। হে বায়ু! তোমার সোমগুণপ্রকাশক বাক্য সোম পানার্থ হব্যদাতা যজমানের নিকট আসছে, অনেকের নিকট আসছে।

সূক্ত - ইন্দ্রবায়ু ইমে সুতা উপ প্রয়োভিরা গতম্। ইন্দবো বামুশন্তি হি।।৪
অনুবাদ : ।।৪।। হে ইন্দ্র (৩) ও বায়ু! এ সোমরস অভিষুত হয়েছে, অন্ন নিয়ে এস; সোমরস তোমাদের কামনা করছে।

সূক্ত - বায়বিন্দ্রশ্চ চেতথঃ সুতানাং বাজিনীবসু। তাবা যাতমুপ দ্রবৎ।।৫
অনুবাদ : ।।৫।। হে বায়ু ও ইন্দ্র! তোমরা অভিষুত সোমরস জান, তোমরা অন্নযুক্ত হব্যে বাস কর; শীঘ্র নিকটে এস। 

সূক্ত - বায়বিন্দ্রশ্চ সুন্বত আ যাতমুপ নিশকৃতম্। মক্ষ্বিথা ধিয়া নরা।।৬
অনুবাদ : ।।৬।। হে বায়ু ও ইন্দ্র! অভিষবকারী যজমানের অভিষুত সোমরসের নিকটে এস; হে বীরদ্বয়! এ কাজ ত্বরায় সম্পন্ন হবে।

- মিত্রং হুবে পূতদষং বরুণং চ ভিশাদসম্। ধিয়ং ঘ্ররতাচয়ং সান্ধতা।।৭
অনুবাদ : ।।৭।। পবিত্রবল মিত্র ও হিংসকশত্রুনাশক বরুণকে (৪) আমি আহ্বান করি; তাঁরা ঘৃতাহুতি প্রদান রূপ কর্ম সাধন করেন।

সূক্ত - ঋতেন মিত্রাবরুণাবৃতাবৃধাবৃতস্পৃশা। ক্রতুং বৃহন্তমাশাথে।।৮
অনুবাদ : ।।৮।। হে যজ্ঞ বর্ধয়িতা যজ্ঞস্পর্শী মিত্র ও বরুণ! তোমরা যজ্ঞফল দানার্থ এ বৃহৎযজ্ঞে রয়েছ।

- কবী নো মিত্রাবরুণা তুবিজাতা উরুক্ষয়া। দক্ষং দধাতে অপসম্।।৯
অনুবাদ : ।।৯।। ইন্দ্র ও বরুণ মেধাসম্পন্ন, বহু লোকের হিতার্থে জাত ও বহু লোকের আশ্রয়ভূত; তাঁরা আমাদের বল ও কর্ম পোষণ করেন।

টীকাঃ-
১। বায়ুও আদিম আর্যগণের আরাধ্য দেব ছিলেন, সুতরাং সে জাতির ভিন্ন ভিন্ন শাখার মধ্যে পূজনীয় ছিলেন। প্রাচীন ইরানীয়দের 'অবস্থা' নামক জেন্দ ভাষায় লিখিত ধর্ম পুস্তকে 'বায়ু' দেবের উল্লেখ আছে। প্রথম সূক্তের প্রথম ঋকের টীকার যাস্কের নিরুক্ত হতে যে অংশ উদ্ধৃত হয়েছে তাতে প্রাচীন হিন্দুদের প্রধান দেবগণের মধ্যে বায়ুর নাম আছে।
২। সোমলতা পেষণ করলে দুগ্ধের ন্যায় শ্বেতবর্ণ এবং ঈষৎ অম্লরস নির্গত হয়, তাই মাদক অবস্থায় পরিণত করে পূর্বকালে যজ্ঞে ব্যবহৃত হত। প্রাচীন আর্যদের মধ্যে সোমরসের ব্যবহার ছিল, অতএব সে আর্য জাতির শাখা ইরানীদের মধ্যে সোমের ব্যবহার ও উপাসনা ছিল। তারা সোমকে 'হওমা বলতেন ও যজ্ঞে এর অভিষব দিতেন। বোধ হয় ইরাণীয় আর্যগণ সোমরস স্বাভাবিক অবস্থায় (unfermented) ব্যবহার করতেন এবং হিন্দু আর্যগণ সোমরস মাদক অবস্থায় (fermented) পান করতে ভাল বাসতেন এবং ঐ দুই আর্যজাতির বিবাদের এটি একটি কারণ।
৩। ভারতবর্ষে নদীর জ
, ভূমির উর্বরতা, ধান ও খাদ্য দ্রব্য, মানুষের সুখ ও জীবন; সমস্তই বৃষ্টির উপর নির্ভর করে, অতএব বৃষ্টিদাতা আকাশদেব ইন্দ্রের গৌরব অধিক। তাঁর নাম যাস্ক হতে উদ্ধৃত সূত্রে আছে,এবং তাঁর সন্বন্ধে যত সূক্ত আছে, অন্য কোন দেব সন্বন্ধে তত নেই।
৪। মিত্র আর্যদিগের একজন উপাস্য দেবতা ছিলেন সুতরাং প্রাচীন হিন্দু ও ইরানীয় উভয় শাখার মধ্যে তাঁর অর্চনা দেখা যায়। ইরানীয়দের মধ্যে 'মিথ্র' আলোক বাঁ সূর্য বলে পূজিত হতেন, হিন্দুদের মধ্যে মিত্র আলোক বা দিবা বলে পূজিত হতেন। বরুণ আর্যদের আরও পুরান দেবতা। আবরণকারী (বৃ ধাতু হতে) নৈশ আকাশকেই আর্যগণ বরুণ বলে পূজা করতেন, এবং সে দেবকে গ্রীকগণ Uranos, ইরানীয়গণ 'বরণ' নামে জানেন। "মৈত্রং বৈ অহরিতি শ্রূতেঃ ** শ্রয়তে চ বারুণী রাত্রী।" - সায়ণ। আকাশ জলীয়, এ বিশ্বাস হতে অবশেষে বরুণ জলের দেব বলে পরিগণিত হলেন।

ঋগবেদ-সংহিতা : প্রথম মন্ডল : ১ সূক্ত

অগ্নি দেবতা। বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা ঋষি। গায়ত্রী ছন্দ।

সূক্ত - অগ্নিমীলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবমূত্বিজম্। হোতারং রত্নধাতমম্।।১।।
অনুবাদ : ।।১।। অগ্নি (১) যজ্ঞের পুরোহিত (২) এবং দীপ্তিমান; অগ্নি দেবগনের আহ্বানকারী ঋত্বিক এবং প্রভূতরত্নধারী; আমি অগ্নির স্তুতি কর।

সূক্ত - অগ্নিঃ পূর্বেভি র্ঋষিভিরীদ্যো নূতবৈরূত। স দেবাঁ এহ বক্ষতি।।২।।
অনুবাদ : ।।২।। অগ্নি পূর্ব ঋষিদের স্তুতিভাজন ছিলেন, নূতন ঋষিদেরও স্তুতিভাজন; তিনি দেবগণকে এ যজ্ঞে আনুন।

সূক্ত - অগ্নিনা রয়িমশ্নবৎ পোষমেব দিবেদিবে। যশসং বীরবত্তমম্।।৩
অনুবাদ : ।।৩।। অগ্নিদ্বারা যজমান ধনলাভ করেন, সে ধন দিন দিন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও যশোযুক্ত হয় ও তা দিয়ে অনেক বীরপুরুষ নিযুক্ত করা যায়।

- অগ্নে যং যজ্ঞমধ্বরং বিশ্বতঃ পরিভূরসি। স ইদ্দেবেষু গচ্ছতি।৪
অনুবাদ : ।।৪।। হে অগ্নি! তুমি যে সজ্ঞ চারদিকে বেষ্টন করে থাক সে যজ্ঞ কেউ হিংসা করতে পারে না এবং সে যজ্ঞ নিঃসন্দেহেই দেবগণের নিকটে গমন করে।

সূক্ত - অগ্নি র্হোতা কবিক্রতুঃ সত্যশ্চিত্রশ্রবস্তমঃ। দেবো দেবেভিরা গমৎ।।৫
অনুবাদ : ।।৫।। অগ্নি দেবগণের আহবানকারী; সিদ্ধকর্মা, সত্যপরায়ণ ও প্রভূত ও বিবিধ কীর্তিযুক্ত; সে দেব দেবগণের সঙ্গে এ যজ্ঞে আগমন করুন।

সূক্ত - যদঙ্গ দাশুষে ত্বমগ্নে ভদ্রং করিষ্যসি। তবেত্তৎ সত্যমঙ্গিরঃ।।৬
অনুবাদ : ।।৬।। হে অগ্নি! তুমি হব্যদাতা যজমানের যে কল্যাণ সাধন করবে, হে অঙ্গিরা সে কল্যাণ প্রকৃত তোমারই।

সূক্ত - উপ ত্বাগ্নে দিবেদিবে দোষাবস্ত র্ধিয়া বয়ম্। নমো ভরন্ত এমসি।।৭
অনুবাদ : ।।৭।। হে অগ্নি! আমরা দিনে দিনে দিনরাত মনের সাথে নমস্কার সম্পাদন করে তোমার সমীপে আসছি।

সূক্ত - রাজন্তমধ্বরাণাং গোপয়ামৃতস্য দীদিবিম্। বর্ধমানং স্বে দমে।।৮
অনুবাদ : ।।৮।। তুমি দীপ্যমান, তুমি যজ্ঞের রক্ষক, যজ্ঞের অতিশয় দীপ্তিকারক, এবং যজ্ঞশালায় বর্ধনশীল।

সূক্ত - স নঃ পিতেব সূনবেহগ্নে সূপায়নো ভব। সচস্বা নঃ স্বস্তয়ে।।৯
অনুবাদ : ।।৯।। পুত্রের নিকট পিতা যেরূপ অনায়াসে অধিগম্য, হে অগ্নি! তুমি আমাদের নিকট সেরূপ হও; মঙ্গলার্থ আমাদের নিকটে বাস কর।

টীকাঃ-
১। "নৈরুক্তদের মতে দেব তিন জন, পৃথিবীতে অগ্নি, অন্তরিক্ষে ইন্দ্র বাঁ বায়ু এবং আকাশে সূর্য। তাঁদের মহাভাগ্য কারণ এক জনের অনেকগুলি নাম, অথবা এটি পৃথক পৃথক কর্মের জন্য, যথা হোতা, অধ্বর্যু, ব্রহ্মা, উদগতা অথবা তাঁরা পৃথক পৃথক দেবই ছিলেন, কেন না তাঁদের পৃথকরূপে স্তুতি করা হয়েছে এবং পৃথক পৃথক নাম দেওয়া হয়েছে।" নিরক্ত ৭।৫। এ থেকে বোঝা যায় যে সে সময়ে ভারতবর্ষের তিন জন অগ্রগণ্য দেবের মধ্যে অগ্নি একজন ছিলেন। ঋগ্বেদ সংহিতায় অগ্নি সন্বন্ধে যতগুলি সূক্ত আছে, ইন্দ্র ভিন্ন অন্য কোনও দেব সন্বন্ধে ততগুলি নেই।
২। অগ্নি না হলে যজ্ঞ হয় না, এ জন্য ঋগ্বেদে অনেক স্থলে অগ্নিকে পুরোহিত বলা হয়েছে। "যথা রাজ্ঞঃ পুরোহিতঃ তদভীষ্টং সম্পাদয়তি তথা অগ্নিরপি অপেক্ষিতং হোমং সম্পাদিত যদ্বা যজ্ঞস্য সঙ্গন্ধিনি পূর্বভাগে আহবনীয়রূপেণ অবস্থিতম্।" - সায়ণ।

Thursday, August 4, 2011

ওঁ সামবেদ - প্রথম অধ্যায়ঃ পুর্বার্চিকঃ ছন্দ আর্চিকঃ আগ্নেয় কান্ডঃ অগ্নিস্তুতি


প্রথম খন্ডঃ মন্ত্র সংখ্যা ১০ ৷৷ মন্ত্রের দেবতা অগ্নি ৷৷ মন্ত্রের ছন্দ গায়ত্রী ৷৷ মন্ত্রের ঋষিঃ ১।২।৪।৭।৯ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য; ৩ মেধাতিথি কান্ব; ৫ তশনা কাব্য; ৬ সুদীতি পুরুমীঢ় আঙ্গিরস; ৮ বৎস কান্ব; ১০ বামদেব ৷৷

মন্ত্রঃ- (০১) অগ্ন আ যাহি বীতয়ে গৃণানো হব্যদাতয়ে। নি হোতা সৎসি বর্হিষি ৷৷ ১ ৷৷

অর্থঃ- (০১) হে অগ্নি, আনন্দের জন্য এস; স্তবযুক্ত হয়ে দেবলোকে আহূতিভার বহনের জন্য এস; হে দেবগণের আহ্বাতা; যজ্ঞাসনে উপবেশন কর।।


মন্ত্রঃ- (০২) ত্বমগ্নে যজ্ঞানাং হোতা বিশ্বেষাং হিতঃ। দেবেভির্মানুষে জনে ৷৷ ২ ৷৷
অর্থঃ- (০২) তুমি হে অগ্নি, সকল যজ্ঞের হোতা। দেবতাদের সঙ্গে যুক্তভাবে প্রতি মানুষে, প্রতি জীবে হিতকারী।


মন্ত্রঃ- (০৩) অগ্নিং দূতং বৃণীমহে হোতারা বিশ্ববেদসম্। অস্য যজ্ঞস্য সুক্রতুম্ ৷৷ ৩ ৷৷
অর্থঃ- (০৩) এই যজ্ঞের সকর্মা (মঙ্গলসম্পাদক), দেবগণের দূত, হোতা, বিশ্বধন অগ্নিকে বরণ করি।


মন্ত্রঃ- (০৪) অগ্নির্বৃত্রাণি জঙ্ঘনদ্ দ্রবিণস্যুর্বিপন্যয়া। সমিদ্ধঃ শুক্র আহূতঃ ৷৷ ৪ ৷৷
অর্থঃ- (০৪) আবরকশক্তিকে পুনঃ পুনঃ বিনাশের জন্য অগ্নি মেধাশক্তি দ্বারা সতত গমনস্বভাবযুক্ত। তিনি প্রাণসন্দীপ্ত, জয়োতিস্মান্ , সকল কামনায় আহূত।


মন্ত্রঃ- (০৫) প্রেষ্ঠং বো অতিথিং স্তুষে মিত্রমিব প্রিয়ম্। অগ্নে রথং ন বেদ্যম্ ৷৷ ৫ ৷৷
অর্থঃ- (০৫) প্রিয়তম অতিথিকে, মিত্রের ন্যায় প্রিয় অগ্নিকে তোমাদের জন্য তোষণ করি। হে অগ্নি, তুমি সূর্যের  মত জ্ঞেয়।


মন্ত্রঃ- (০৬) ত্বং নো অগ্নে মহোভিঃ পাহি বিশ্বস্যা অরাতেঃ। উত দ্বিষো মর্ত্যস্য ৷৷ ৬ ৷৷
অর্থঃ- (০৬) তুমি আমাদের, হে অগ্নি মহাধনে পালন কর। সকল শত্রু হতে আর মর্ত্যের দ্বেষ হতে রক্ষা কর।


মন্ত্রঃ- (০৭) এহ্যূ ষু ব্রবাণি তেহগ্ন ইত্থেতরা গিরঃ। এভির্বর্ধাস ইন্দুভিঃ ৷৷ ৭ ৷৷
অর্থঃ- (০৭) এস হে অগ্নি, তোমাকে এ ভাবেই স্তুতি করবো। এ ভাবেই সকল যজ্ঞের দ্বারা তুমি বর্ধিত হও।


মন্ত্রঃ- (০৮) আ তে বৎসো মনো যমৎ পরমাচ্চিৎ সধস্থাৎ।  অগ্নে ত্বাং কাময়ে গিরা ৷৷ ৮ ৷৷
অর্থঃ- (০৮) এস হে অগ্নি পরমলোক থেকে। বৎস ঋষি তোমাকে কামনা করে স্তবমালায় তোমার মন আকর্ষণ করে।


মন্ত্রঃ- (০৯) ত্বামগ্নে পুস্করাদধ্যথর্বা মূর্ধ্নো বিশ্বস্য বাঘতঃ ৷৷ ৯ ৷৷
অর্থঃ- (০৯) তোমাকে, হে অগ্নি, স্বকর্মে অবিচল আদিত্য (=অথর্ব) যিনি বিশ্বের ঋত্বিক, তিনি শীর্ষে অবস্থান করে অন্তরিক্ষ হতে মন্থন করে আনেন।


মন্ত্রঃ- (১০) অগ্নে বিবস্বদা ভরাস্মভ্যমূতয়ে মহে। দেবো হ্যসি নো দৃশে ৷৷ ১০ ৷৷
অর্থঃ- (১০) হে অগ্নি, তমোনাশক তুমি, আমাদের পালনের জন্য মহাধন আন আর আমাদের দর্শনের জন্য তুমিই দেবতা।


দ্বিতীয় খন্ডঃ মন্ত্র সংখ্যা ১০।। মন্তের দেবতা অগ্নি।। মন্তের ছন্দ গায়ত্রী।। মন্তের ঋষিঃ ১ আয়ুঙ্ ক্ষ্বাহি, বিরূপা আঙ্গিরস, ২ বামদেব গৌতম, ৩।৮।৯ প্রয়োগ ভার্গব, ৮ মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র, ৫।৭ শূ্নঃশেপ আজীগর্তি, ৬ মেধাতিথি কান্ব, ১০ বৎস কান্ব।।

মন্ত্রঃ- (১১) মনস্তে অগ্ন ওজসে গৃণন্তি দেব কৃষ্টয়ঃ। অমৈরমিত্রমর্দয় ।।১।।
অর্থঃ- (১১) হে অগ্নি, মানুষেরা ওজঃশক্তির জন্য নত হয়ে তোমার স্তব করে। হে দেব, বলপ্রভাবে অমিত্রকে (=শত্রুকে) পীড়িত কর।।

মন্ত্রঃ- (১২) দূতং বো বিশ্ববেদসং হব্যবাহমমর্ত্যম্। যজিষ্ঠমৃঞ্জসে গিরা ।।২।।
অর্থঃ- (১২) হে জনগণ, তোমাদের মঙ্গলের জন্য দেবদূত বিশ্বধন হব্যবাহী অমৃত যাজ্ঞিকশ্রেষ্ঠ অগ্নিকে স্তবের দ্বারা শোভিত কর।।

মন্ত্রঃ- (১৩) উপ দ্বা জাময়ো গিরো দেদিশতীর্হবিষ্কৃতঃ। বায়োরনীকে অস্থিরন্ ।।৩।।
অর্থঃ- (১৩) হে অগ্নি, যজ্ঞনিস্পাদকের বারবার উচ্চারিত দীপ্ত স্তবমালা তোমাকে প্রাপ্ত হবার জন্য মুখ্যপ্রাণ বায়ুর নিকটে অবস্থান করে।।

মন্ত্রঃ- (১৪) উপ ত্বাগ্নে দিবে দিবে দোষাবস্তর্ধিয়া বয়ম্। নমো ভরন্ত এমসি ।।৪।।
অর্থঃ- (১৪) হে তমোনাশক অগ্নি, প্রতিদিন আমরা প্রজ্ঞাদ্বারা নত হয়ে নমস্কার করতে করতে তোমাকেই কাছে পাই।।

মন্ত্রঃ- (১৫) জরাবোধ তদ্বিবিড্ ঢি বিশেবিশে যজ্ঞিয়ায়। স্তোমং রুদ্রায় দৃশীকম্ ।।৫।।
অর্থঃ- (১৫) হে স্তুতিদ্বারা প্রবুদ্ধ অগ্নি, ভিন্ন ভিন্ন মানুষের প্রয়োজনে যজ্ঞযোগ্য রুদ্রের উদ্দেশ্যে যে অলোকসামান্য স্ত্রোত্র তা তুমিই জান।।

মন্ত্রঃ- (১৬) প্রতি ত্যং চারুমধ্বরং গোপীথায় প্র হূয়সে। মরুদ্য ভিরগ্ন আ গহি ।।৬।।
অর্থঃ- (১৬) আমাদের রক্ষণের জন্য যে শোভন যজ্ঞে তুমি আহূথ হও সেখানে তুমি হে অগ্নি, সকল প্রাণশক্তির সঙ্গে এস।।

মন্ত্রঃ- (১৭) অশ্বং ন ত্বা বারবন্তং বন্দধ্যা অগ্নিং নমোভিঃ। সম্রাজন্তমদ্বরাণাম্ ।।৭।।
অর্থঃ- (১৭) সকল যজ্ঞের সম্রাট্ অশ্বপুচ্ছের মত শিখাবিশিষ্ট অগ্নি তোমাকে নমস্কারের দ্বারা বন্দনা করতে প্রবৃত্ত হই।।

মন্ত্রঃ- (১৮) ঔর্বভৃণ্ডবচ্ছুচিমপ্নবানবদা হুবে। অগ্নিং সমুদ্রবাসসম্ ।।৮।।
অর্থঃ- (১৮) পৃথিবীজাত অগ্নিশিখাসম্ভূত রূপবানের ন্যায় অন্তিরিক্ষে নিবাসকারী শুচি অগ্নিকে সকল দিক হতে আহ্বান করি।।

মন্ত্রঃ- (১৯) অগ্নিমিন্ধানো মনসা ধিয়ং সচেত মর্ত্যঃ। অগ্নিমিন্ধে বিবস্বভিঃ ।।৯।।
অর্থঃ- (১৯) মর্ত্যের মানুষ অগ্নিকে প্রজ্বলিত করে মনের সহায়তায় কর্মে মিলিত হয়; জ্ঞানের দ্বারাও অগ্নিদেবকে প্রজ্বালিত করে।।

মন্ত্রঃ- (২০) আদিৎ প্রত্নস্য রেতসো জ্যোতি পশ্যন্তি বাসরম্। পরো যদিধ্যতে দিবি ।।১০।।
অর্থঃ- (২০) ঊর্ধ্বে দ্যুলোকে যা দীপ্তিলাভ করে তা স্বর্গীয় বারি হতে জ্যোতি আহরণ করে দিনের আলো দেখে।।


তৃতীয় খন্ডঃ মন্ত্র সংখ্যা ১৪।। মন্তের দেবতা অগ্নি।। ছন্দ গায়ত্রী।। মন্ত্রের ঋষিঃ ১ প্রয়োগ ভার্গব; ২।৫ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য; ৩।১০ বামদেব গৌতম; ৪।৬ বসিষ্ঠ মেত্রাবরুণি; ৭ বিরূপ আঙ্গিরস; ৮ শূনঃশেপ আজীগর্তি; ৯ গোপবন আত্রেয়; ১১ প্রস্কন্ব কান্ব; ১৩ সিন্ধুদ্বীপ আন্বরীষ বা ত্রিত আপ্ত্য; ১৪ উশনা কাব্য।।

মন্ত্রঃ- (২১) অগ্নিং বো বৃধন্তমধ্বরাণাং পুরুতমম্। অচ্ছা নপ্ত্রে সহস্বতে।।১।।
অর্থঃ- (২১) তোমাদের সন্তানের জন্য, বলের জন্য অহিংসিত যজ্ঞের বধর্নকারী অতিব্যাপ্ত অগ্নিকে প্রাপ্ত হও।

মন্ত্রঃ- (২২) অগ্নিস্তিগ্মেন শোচিষা যংসদ্বিশ্বং ন্যত্ত্রিণম্। অগ্নির্নো বৎসতে রয়িম্।।২।।
অর্থঃ- (২২) অগ্নি তীকশ্ন জ্যোতিশিখাদ্বারা বিশ্বধন নিয়ন্ত্রণ করেন। অগ্নি আমাদের ধনদাতা।।

মন্ত্রঃ- (২৩) অগ্নে মৃড় মহাঁ অস্যয আ দেবয়ুং জনম্। ইয়েথ বর্হিরাসদম্।।৩।।
অর্থঃ- (২৩) হে অগ্নি, আমাদের সুখী কর; তুমি মহান। দেবকাম ব্যক্তিকে অনুগ্রহের জন্য যজ্ঞাসনে উপবেশন কর।।

মন্ত্রঃ- (২৪) অগ্নে রক্ষা ণো অংহসঃ প্রতি স্ম দেব রীষতঃ। তপিষ্ঠৈরজরো দহ।।৪।।
অর্থঃ- (২৪) হে অগ্নি, আমাদের পাপ হতে রক্ষা কর। হে দেব, হিংসকদের হাত থেকে রক্ষা কর। তোমার তপের তাপে স্তুতিহীনদের দহন কর।।

মন্ত্রঃ- (২৫) অগ্নে যুঙ্ ক্ষ্বা হি যে তবাশ্বাসো দেব সাধবঃ। অরং বহন্ত্যাশবঃ।।৫।।
অর্থঃ- হে অগ্নি, তোমার যে সকল সৎকর্মপরায়ণ আলোকরশ্মিদের নিজরথে যুক্ত কর যে ক্ষিপ্রকর্মকুশলেরা তোমাকে সর্বত্র বহন করে।।

মন্ত্রঃ- (২৬) নি ত্বা লক্ষ্য বিশ্ পতে দ্যুমন্তং ধীমহে বয়ম্। সুধীরমগ্ন আহুত।।৬।।
অর্থঃ- (২৬) তোমার প্রতি গমনশীল আমরা, হে জনগণপালক সুবীর আহূত অগ্নি, দীপ্যমান তোমাকেই ধ্যান করি।।

মন্ত্রঃ- (২৭) অগ্নির্মুর্ধা দিবঃ ককুৎপতিঃ পৃথিব্যা অয়ম্। অপাং রেতাংসি জিনবতি।।৭।।
অর্থঃ- (২৭) অগ্নি দ্যুলোকের মস্তক, এক পৃথিবীরও শীর্ষস্থানীয়। তিনি বারিধারায় সকলকে প্রীত করেন।।

মন্ত্রঃ- (২৮) ইমমু ষু ত্বম্ স্মাকং সনিং গায়ত্রং নব্যাংসম্। অগ্নে দেবেষু প্র বোচঃ।।৮।।
অর্থঃ- (২৮) হে অগ্নি, গায়ত্রীছন্দে রচিত নবতর স্তুতি আমাদের এ উপহার তুমি দেবগণের মধ্যে প্রচার কর।।

মন্ত্রঃ- (২৯) যং ত্বা গোপবনো গিরা জনিষ্ঠদগ্নে অঙ্গিরঃ। স পাবক শ্রুধী হবম্।।৯।।
অর্থঃ- (২৯) যে তোমাকে গোপবন ঋষি স্তবে তুষ্ট করলো সেই তুমি হে অগ্নি, হে অঙ্গির, হে পাবক, আমাদের আহ্বান শোন।।

মন্ত্রঃ- (৩০) পরি বাজপতিঃ কবিরগ্নির্হব্যান্যক্রমীৎ। দধদ্ রত্নানি দাশুষে।।১০।।
অর্থঃ- (৩০) অন্নবলপতি কবি অগ্নি সকল হব্য বহন করেন; হব্যদাতার জন্য রত্নধারণ করেন।।

মন্ত্রঃ- (৩১) উদূ ত্যং জাতবেদসং দৈবং বহন্তি কেভবঃ। দৃশে বিশ্বায় সূর্যমা।।১১।।
অর্থঃ- (৩১) যিনি প্রাণিমাত্রকেই জানেন সেই সূর্যরূপী অগ্নিদেবকে বিশ্বের দর্শনের জন্য রশ্মিগণ ঊর্ধ্বে বহন করেন।।

মন্ত্রঃ- (৩২) কবিমগ্নিমুপ স্তুহি সত্যধর্মাণমধ্বরে। দেবমমীবচাতনম্।।১২।।
অর্থঃ- (৩২) হে স্তোতা, অহিংসিত যজ্ঞে কবি সত্যধর্মা ব্যাধিনাশক দ্যোতমান অগ্নিকে স্তব কর।।

মন্ত্রঃ- (৩৩) শং নো দেবীরভিষ্টয়ে শং নো ভবন্তু পীতয়ে। শং যোরভিস্রবন্তু নঃ।।১৩।।
অর্থঃ- (৩৩) আমাদের অভিলাষ পূরণের জন্য আমাদের সুখকর পালনের জন্য সকল জলদা-শক্তি কল্যাণবারি বর্ষণের দ্বারা আমাদের সুখী করেন।।

মন্ত্রঃ- (৩৪) কস্য নূনং পরীণসি ধিয়ো জিন্বসি সৎপতে। গোষাতা যস্য তে গিরঃ।।
অর্থঃ- (৩৪) কার বহুকর্মকে পুরণ কর হে সৎপতি? - তোমার উদ্দেশ্যে যার স্তুতি সর্বধনকর।।

চতুর্থ খন্ডঃ মন্ত্র সংখ্যা ১০।। দেবতা অগ্নি।। ছন্দ বৃহতী।। মন্তের ঋষিঃ ১।৩।৭ শংযু বার্হস্পত্য, তৃণপাণি; ২।৫।৮।৯ ভর্গ প্রাগাথ, বশিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি; ৬ প্রস্কন্ব কান্ব, ১০ সৌভরি কান্ব।।

মন্ত্রঃ- (৩৫) যজ্ঞাযজ্ঞা বো অগ্নয়ে গিরাগিরা চ দক্ষসে। প্রপ্র বয়মমৃতং জাতবেদসং প্রিয়ং মিত্রং ন শংসিষম্।।১।।
অর্থঃ- (৩৫) যজ্ঞে যজ্ঞে মন্ত্রে মন্ত্রে তোমাদের জন্য আমরা অমৃতসমান, সর্বজ্ঞ, প্রিয়, মিত্র, প্রশংসনীয় অগ্নির উদ্দেশ্যে সেই পবিত্রবলের উদ্দেশ্যে স্তব করি।।

মন্ত্রঃ- (৩৬) পাহি নো অগ্র একয়া পাহ্যূতত দ্বিতীয়রা। পাহি গীর্ভিস্তিসৃভিরূর্জাম্পতে পাহি চতসৃভির্বসো।।২।।
অর্থঃ- (৩৬) হে অগ্নি, আমাদের প্রথমের দ্বারা ( - ঋগ্বেদের দ্বারা পালন কর। আমাদের দ্বিতীয়ের দ্বারা ( - যজূর্বেদের দ্বারা) পালন কর; হে বলপতি, আমাদের তৃতীয় স্তবমালার দ্বারা ( - সামবেদের দ্বারা) পালন কর; হে ধনী, আমাদের চতুর্থের দ্বারা ( - অথর্ববেদের দ্বারা) পালন কর।।

মন্ত্রঃ- (৩৭) বৃহদ্ভিরগ্নে অর্চিভিঃ শুক্রেণ দেব শোচিষা। ভরদ্বাজে সমিধানো যবিষ্ঠা রেবৎপাবক দীদিহি।।৩।।
অর্থঃ- (৩৭) হে অগ্নি, প্রবল দীপ্তিসহায়ে, হে দেব, শুভ্রজ্যোতি সহায়ে যেমন ভরদ্বাজের কাছে সন্দীপ্ত হও তেমনি হে চিরযুবা, ধনাধীশ, হে পাবক, আমার কাছে প্রকাশিত হও।।

মন্ত্রঃ- (৩৮) ত্বে অগ্নে স্বাহূত প্রিয়াসঃ সন্তু সূরয়ঃ। যন্তারো যে মঘবানো জনানামুর্বং দয়ন্ত গোনাম্।।৪।।
অর্থঃ- (৩৮) সুষ্ঠরূপে আহূত হে অগ্নি, শ্রেষ্ঠদের মধ্যে তাঁরাই তোমার প্রিয় যাঁরা ধনের নিয়ামক হয়ে মানুষ ও পশুর মধ্যে তোমার সম্পদ সম্যক বিভাগ করে দেন।।

মন্ত্রঃ- (৩৯) অগ্নে জরিতর্বিশ্ পপতিস্তপানো দেব রক্ষসঃ। অপ্রোষিবান্ গৃহপতে মহাঁ অসি দিবস্পায়ুর্দুরোণষুঃ।।৫।।
অর্থঃ- (৩৯) হে অগ্নি, হে স্তুত্য, হে জনগণপতি, হে দুষ্টসন্তাপক, হে দেব, হে অচঞ্চল গৃহপতি, তুমি মহান্, দ্যুলোকের পালক, তুমি গৃহপালনের অভিলাষী।।

মন্ত্রঃ- (৪০) অগ্নে বিবস্বদুষশ্চিত্রং রাধো অমর্ত্য। আ দাশষে জাতবেদো বহা ত্বমদ্যা দেবাঁ ঊষবুর্ধঃ।।৬।।
অর্থঃ- (৪০) হে অগ্নি, তমোনাশক তুমি; নিয়ে এস তার জন্য ঊষা হতে বিচিত্র সর্বার্থধন যে তোমাকে চায়; হে অমর্ত্য, হে জাতপ্রজ্ঞান, আজ আন সেই দেবদের যাঁরা ঊষাকালে জাগরিত।।

মন্ত্রঃ- (৪১) ত্বঃ নশ্চিত্র ঊত্যা বসো রাধাংসি চোদয়। অস্য বায়স্তমগ্নে রথীরসি বিদা গাধং তুচে তু নঃ।।৭।।
অর্থঃ- (৪১) হে বিচিত্রধন অগ্নি, আমাদের পালন ইচ্ছা করে সর্বার্থসাধক ধন দান কর; হে অগ্নি, এ ধনের তুমিই চালক যা আমাদের সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করবে।

মন্ত্রঃ- (৪২) ত্বমিৎ সপ্রথা অস্যগ্নে ত্রাতর্ঋতঃ কবিঃ। ত্বাং বিপ্রাসঃ সমিধান দীদিব আ বিবাসন্তি বেধসঃ।।৮।।
অর্থঃ- (৪২) তুমিই সর্বত্র বিস্তৃত হও হে অগ্নি, তুমিই ত্রাতা, তুমিই ঋত (সত্য), তুমিই কবি; হে দেদীপ্যমান, তোমাকে জ্ঞানবৃদ্ধ স্তোতাগণ, সর্বত্র পরিচর্যা করেন।।

মন্ত্রঃ- (৪৩) আ নো অগ্নে বয়োবৃধং রয়িং পাবক শংস্যম্। রাস্বা চ ন উপমাতে পুরুস্পৃহং সুনীতি সুযশস্তরম্।।৯।।
অর্থঃ- (৪৩) হে অগ্নি, আমাদের জন্য আয়ুকারক প্রশংসনীয় ধন আন; হে পাবক, হে কাছের দেবতা, সুনীতিযুক্ত সুযশ বহস্পৃহ ধন দাও।।

মন্ত্রঃ- (৪৪) যো বিশ্বা দয়তে বসু হোতা মন্দ্রো জনানাম্। মঘোর্ন পাত্রা প্রথমান্যস্মৈ প্র স্তোমা যন্ত্বগ্নয়ে।।১০।।
অর্থঃ- (৪৪) যিনি বিশ্বধন, বসু, হোতা, জনগণের আনন্দদায়ক, সেই অগ্নির উদ্দেশ্যে সব স্তুতিমন্ত্র মধুপূর্ণ পাত্রের মত যাচ্ছে।।

পঞ্চম খণ্ডঃ মন্ত্র সংখ্যা ১০।। দেবতা অগ্নি।। ৮ ইন্দ্র।। ছন্দ বৃহতী।। ঋষি - ১ বশিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি; ২ ভর্গ প্রাগাথ; ৩।৭ সৌভরি কান্ব; ৪ মনু বৈবস্বতি; ৫ সুদীতিপুরমীঢ় আঙ্গিরস; ৬ প্রস্কন্ব কান্ব; ৮ কান্ব মেধাতিথি ও মেধ্যাতিথি; ৯ গাথি বিশ্বামিত্র; ১০ ঘৌর কন্ব।।

মন্ত্রঃ- (৪৫) এনা বো অগ্নিং নমসোর্জো নপাতমা হূবে। প্রিয়ং চেতিষ্ঠমরতিং স্বধ্বরং বিশ্বস্য দূতমমৃতম্।।১।।
অর্থঃ- (৪৫) তোমাদের জন্য বলপুত্র প্রিয় উত্তমচৈতন্য ভ্রমণশীল সুযজ্ঞ বিশ্বদূত অমৃতসমান অগ্নিকে স্তবের দ্বারা আহ্বান করি।।

মন্ত্রঃ- (৪৬) শেষে বনেষু মাতৃষু সং ত্বা মর্তাস ইন্ধতে। অতন্দো হব্যং বহসি হবিস্কৃত আদিদ্দেবেষু রাজসি।।২।।
অর্থঃ- (৪৬) হে অগ্নি, বনে মাতৃরূপা কাষ্ঠমধ্যে তুমি নিদ্রা যাও, মানুষেরা তোমাকে প্রজ্বালিত করে, তুমি হব্যদাতার হব্য অনলস অতন্দ্র হয়ে বহন করে থাক, তারপর দেবজ্যোতির মধ্যে দীপ্তিলাভ কর।।

মন্ত্রঃ- (৪৭) অদর্শি গাতুবিত্তমো যস্মিন্ ব্রতান্যাদধুঃ। উপো ষু জাতমার্যস্য বর্ধনমগ্নিং নক্ষন্তু নো গিরঃ।।৩।।
অর্থঃ- (৪৭) সকল পথের সন্ধান যিনি জানেন, যাঁর মধ্যে সকল ব্রত ধৃত আছে সেই অগ্নি দেখা দিলেন। আর্যগণের জন্য জাত জ্ঞানবৃদ্ধিকর অগ্নি আমাদের সকল স্তুতি গ্রহণ করুন।

মন্ত্রঃ- (৪৮) অগিরুক্ থে পুরোহিতো গ্রাবাণো বর্হিরধ্বরে। ঋচা যামি মরুতো ব্রহ্মণস্পতে দেবা অবো বরেণ্যম্।।৪।।
অর্থঃ- (৪৮) অগ্নি দ্যুলোকাগ্নির মধ্যে প্রধান, আকাশে মেঘের মধ্যে জলের সাথে বর্তমান। হে ব্রহ্মের পালক অগ্নি, প্রাণবায়ু মরুদগনের কাছে বর্ষমিরূপ বরণীয় পালন ঋক্ মন্ত্রের দ্বারা যাচ্ ঞা করি।

মন্ত্রঃ- (৪৯) অগ্নিমীড়িম্বাবসে গাথাভিঃ শীরশোচিষম্। অগ্নিং রায়ে পুরুমীঢ় শ্রুতং নরোহগ্নিঃ সুদীহয়ে ছর্দিঃ।।৫।।
অর্থঃ- (৪৯) যে পুরুমীঢ়, তেনু আত্মরক্ষার জন্য পবিত্র শিখা অগ্নিকে গাথাদ্বারা স্তর কর, খ্যাত অগ্নিকে ধনের জন্য স্তব কর, সুদীতির জন্য কামনা কর, অন্য লোকেও এইভাবে অগ্নিকে স্তব কর।

মন্ত্রঃ- (৫০) শ্রুাধ শ্রুৎকর্ণ বহ্নিভি-র্দেবৈরগ্নে সয়াবভিঃ। আসীদতু বর্হিষি মিত্রো অর্যমা প্রাতর্যাবভিরধ্বরে।।৬।।
অর্থঃ- (৫০) শোন হে অগ্নি, হে শ্রবণসমর্থ, আমার বচন; যে দেবেরা তোমার সঙ্গে হন্য বহন করেন তাঁদের নিয়ে এবং মিত্র অর্যমা ও প্রাতর্যাগে আগমনকারী অন্যদেবতাদের সঙ্গে নিয়ে এই অহিংসিত যজ্ঞে এসে যজ্ঞাসনে বোসো।

মন্ত্রঃ- (৫১) প্রে দৈবদাসো অগ্নির্দেব ইন্দ্রো ন মজ্ মনা। অনু মাতরং পৃথিবীং বি বাবৃতে তস্থৈ নাদন্য শর্মণি।।৭।।
অর্থঃ- (৫১) ইন্দের মত মলবাণ দৈবকর্মা অগ্নিদেব মাতা পৃথিবীকে আবৃত করে দ্যুলোকের আশ্রয়ে অবস্থিত থাকেন।

মন্ত্রঃ- (৫২) অধ মুমো অধ বা দিবো বৃহতো রোচনাদধি। অয়া বর্ধস্ব তন্বা গিরা মমা জাতা সুক্রতো পৃণ।।৮।।
অর্থঃ- (৫২) পৃথিবী হতে, দ্যুলোক হতে, অথবা বিশাল আলোকলোক হতে এস হে, সুক্রতু (সুকর্মা), আমার স্তুতিতে বেড়ে ওঠ, আমার সন্তানদের কামনা পূর্ণ কর।

মন্ত্রঃ- (৫৩) কায়মানো বনা ত্বং যন্মাতুরঞ্জগন্নপঃ। ন তত্তে অগ্নে প্রমৃষে নিবর্তনং যদ্ দূরে সন্নিথা ভুবঃ।।৯।।
অর্থঃ- (৫৩) হে অগ্নি, যখন তোমার নিজের উৎপত্তিস্থান বনকাষ্ঠমধ্যে ও সকলজীবের স্রষ্ট জলরাশিকে কামনা করে তাদের মধ্যে প্রবেশ কর তখন তুমি চিরতরে হারিয়ে যাও না তুমি আমাদের থেকে দূরে গেলেও আবার ফিরে আস।

মন্ত্রঃ- (৫৪) মি ত্বামগ্নে মনূর্দধে জ্যোতির্জনায় শশ্বতে। দীদেথ কন্ব ঋতজাত উক্ষিতো যং নমস্যন্তি কৃষ্টয়ঃ।।১০।।
অর্থঃ- (৫৪) জ্যোতিস্বরূপ্ তোমাকে হে অগ্নি, মানুষের হিতের জন্য সূর্যদেব সদাই ধারণ করেন; মেধাবী সত্যজাত সদা বর্ধমান তুমি দীপ্তিলাভ কর, যে তোমাকে মানুষেরা নমস্কার জানায়।

ষষ্ঠ খন্ডঃ মন্ত্র সংখ্যা ৮।। দেবতা অগ্নি, ২ ব্রহ্মণস্পতি; ৩ যূপকাষ্ঠ।। ছন্দ বৃহতী।। ঋষিঃ ১।৭ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি, ২।৩।৫ ঘৌর কন্ব, ৪ সৌভরি কান্ব, ৬ উৎকীল কাত্য, ৮ গাথি বিশ্বামিত্র।।

মন্ত্রঃ- (৫৫) দেবো বো দ্রবিণোদাঃ পূর্ণাং বিবষ্টবাসিচম্। উদ্বা সিঞ্চধ্বমুপ বা পৃণধ্বমাদিদ্বো দেব ওহতে।।১।।
অর্থঃ- (৫৫) দ্রবিণোদা দেব (=অগ্নিদেব) তোমাদের পূর্ণ ভক্তি কামনা করেন। তাঁকে প্রীত কর, ভক্তিরসে সিক্ত কর, তিনি তোমাদের ভার বহন করবেন।

মন্ত্রঃ- (৫৬) প্রৈতু ব্রহ্মণস্পতিঃ প্র দেব্যেতু সূনৃতা। অচ্ছা বীরং নর্যং পঙ্ ক্তিরাধসং দেবা যজ্ঞং নয়ন্তু নঃ।।২।।
অর্থঃ- (৫৬) বেদপালক ব্রহ্মণপতি অগ্নিদেব আসুন, প্রিয়সত্য বাগ্ দেবী আসুন; বীর্যপ্রদ নরহিতকর সর্বার্থক ধনযুক্ত যজ্ঞকে দেবগণ আমাদের কাছে আনুন।

মন্ত্রঃ- (৫৭) ঊর্ধ্ব ঊ ষু উতয়ে তিষ্ঠো দেবো ন সবিতা। ঊর্ধ্বো বাজস্য সনিতা যদঞ্জিভির্বাঘদ্ভির্বি হুয়ামহে।।৩।।
অর্থঃ- (৫৭) সবিতাদেব যেন ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের রক্ষা করেন তেমনি তুমি উন্নত থেকে আমাদের রক্ষক হও, অন্নবলদাতা হও, অন্নবলদাতা হও; তোমাকে বিদ্বান ঋতিক্ দের সহায়তায় আহবান জানাচ্ছি।

মন্ত্রঃ- (৫৮) প্র যো রায়ে নিনীষতি মর্তো যস্তে বসো দাশৎ। স বীরং ধত্তে অগ্নঃ উক্ থশংসিনং ত্মনা সহস্রপোষিণম্।।৪।।
অর্থঃ- (৫৮) হে আশ্রয়দাতা, যে মানুষ ধনের ইচ্ছা করে, যে তোমার উদ্দেশে দ্রব্য নিবেদন করে, হে অগ্নি, সে নিজে বীর ঈশ্বরপূজারী ও বহুজনের পালক হয়।

মন্ত্রঃ- (৫৯) প্র বো যহ্বং পুরুণাং বিশাং দেবয়তীনাম্। অগ্নিং সূক্তেভির্বচোভির্বৃণীমহে যং সমিদন্য ইন্ধতে।।৫।।
অর্থঃ- (৫৯) তোমাদের জন্য বহু মানুষের বহু দেবকাম মানুষের আরাধ্য মহান্ অগ্নিকে স্তবগাথায় আরাধনা করি, যাঁকে অন্যেরাও স্তব করে থাকেন।

মন্ত্রঃ- (৬০) অয়মগ্নিঃ সুবীর্যস্যেশে হি সৌভগস্য। রায় ঈশে স্বপত্যস্য গোমত ঈশে বৃত্রহথানাম্।।৬।।
অর্থঃ- (৬০) এই অগ্নিদেব সুবীর্যের ঈশ্বর; ইনিই সৌভাগ্যের ঈশ্বর; ইনিই ঈশ্বর ধনের, সুসন্তানের, গোধনের; ইনিই ঈশ্বর পাপনাশকারীদের।

মন্ত্রঃ- (৬১) ত্বমগ্নে গৃহপতিস্তং হোতা নো অধ্বরে। ত্বং পোতা বিশ্ববার প্রচেতা যক্ষি যাসি চ বার্যম্।।৭।।
অর্থঃ- (৬১) তুমি হে অগ্নি, গৃহপতি; তুমি হোতা আমাদের যজ্ঞে। তুমি শুদ্ধিকারক, বিশ্ববরেণ্য মহামনা। তুমি যাগ কর আর বরণীয়কে প্রাপ্ত হও।

মন্ত্রঃ- (৬২) সখায়স্তা ববৃমহে দেবং মর্তাস উতয়ে। অপাং নপাতং সুভগং সুদংসসং সুপ্রভূর্তিমনেহসম্।।৮।।
অর্থঃ- (৬২) তুমি আমাদের পালন করবে বলে মর্ত্যবাসী তোমার সখা আমরা তোমায় বরণ করি। তুমি বারিরক্ষক, সুন্দর, বহুর মুক্তিদাতা, সর্বজয়ী, অপ্রতিহত কাল।

সপ্তম খন্ডঃ মন্ত্র সংখ্যা ১০।। দেবতা অগ্নি ।। ছন্দ ১।৩, ৫-৯ ত্রিষ্টুপ, ২।৪ জগতী ১০ ত্রিপাদ্ বিরাট্ গায়ত্রী ।। ঋষিঃ ১ শ্যাবাশ্ব আত্রেয় বা বামদেব গৌতম; ২ উপস্তুত বার্ষ্টিহব্য; ৩ বৃহদুকথ্ বামদেব্য; ৪ কুৎস আঙ্গিরস; ৫।৬ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য; ৭ বামদেব গৌতম; ৮।১০ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি; ৯ ত্রিশিরা ত্বাষ্ট্র।।

মন্ত্রঃ- (৬৩) আ জুহোতা হবিষা মর্জয়ধ্বং নি হোতারং গৃহপতিং দধিধ্বম্। ইডস্পদে নমসা রাতহবাং সপর্যতা যজতং পস্ত্যানাম ।।১।। (৬৪) চিত্র ইচ্ছিশোস্তরুণস্য বক্ষথো ন যো মাতরাবন্বেতি ধাতবে। অনূধা যদজীজনদধা চিদা ববক্ষ সদ্যো মহি দূত্যাংত চরন্।।২।। (৬৫) ইদং ত একং পর উ ত একং তৃতীয়েন জ্যোতিষা সং বিশস্ব। সংবেশনস্তন্বেতচারুরেধি প্রিয়ো দেবানাং পরমে জনিত্রে।।৩।। (৬৬) ইমং স্তোমমর্হতে জাতবেদসে রথমিব নং মহেমা মনীষয়া। ভদ্রা হি নঃ প্রমতিরস্য সংসদ্যগ্নে সখ্যে মা রিষামা বয়ং তব।।৪।। (৬৭) মূর্ধানং দিবো অরতিং পৃথিব্যা বৈশ্বানরমৃত আ জাতমগ্নিম্। কবিং সম্রাজমতিথিং জনানামাসন্নঃ পাত্রং জনয়স্ত দেবাঃ।।৫।। (৬৮) বি ত্বদাপো ন পর্বতস্য পৃষ্ঠাদুকথেভিরগ্নে জনয়স্ত দেবাঃ। তং ত্বা গিরঃ সুষ্টুতয়ো বাজয়ন্ত্যাজিং ন গির্ববাহো জিগ্যুরশ্বাঃ।।৬।। (৬৯) আ বো রাজানমধ্বরস্য রুদ্রং হোতারং সত্যযজং রোদস্যোঃ। অগ্নিং পুরা তনয়িত্নোরচিত্তাদ্ধিরণ্যরূপমবসে কৃণুধ্বম্।।৭।। (৭০) ইন্ধে রাজা সমর্যো নমোভির্যস্য প্রতীকমাহুতং ঘৃতেন। নরো হব্যেভিরীডতে সবাধ আগ্নিরগ্রমুষসামশোচি।।৮।। (৭১) যাত্যগ্নিরা রোদসী বৃষভো রোরবীতি। দিবশ্চিদন্তাদুপমামুদানডপামুপস্থে মহিষো ববর্ধ ।।৯।। (৭২) অগ্নিং নরো দীধিতিভীররণ্যোর্হস্তচ্যুতং জনয়ত প্রশস্তম্। দূরেদৃশং গৃহপতিমথব্যুম্।।১০।।

অনুবাদঃ (৬৩) তাঁর উদ্দেশে নিবেদন কর, হোতাকে প্রশংসিত কর, গৃহপতিকে অন্তরে ধারণ কর; সকল গৃহের উপাস্যকে স্তুতি দ্বারা, যজ্ঞভূমিতে সেই হব্যগ্রহণকারীকে পূজার দ্বারা প্রীত কর। (৬৪) এই শিশুর এই তরুণের কাজ বড়ই বিচিত্র। এ স্তন্যপানের জন্য মায়ের কাছে যায় না। এর মাতার (-অরণি কাষ্ঠ যা থেকে অগ্নি উৎপন্ন) স্তন নেই, তবু এ জন্মমাত্রই মহান দেবদৌত্যকার্যের ভার গ্রহণ করলো।। (৬৫) হে অগ্নি, এই পার্থিব অগ্নি তোমার একরূপ, অন্তরিক্ষে বিদ্যুৎ তোমার আর এক রূপ, আর দ্যুলোকে সুর্যরূপ জ্যোতির্ময় তোমার শরীর তৃতীয়রূপ - এ তিন রূপে তুমি সকল কিছুর মধ্যে প্রবেশ কর। তারপর তুমি কল্যাণরূপ ধারণ করে দেবশ্রেষ্ঠ পরমপিতা সূর্যদেবের প্রিয় হও।। (৬৬) সুর্যসমান পূজনীয় সর্বজ্ঞান অগ্নির উদ্দেশে প্রজ্ঞার দ্বারা এই স্তুতি রচনা করি। অগ্নির উপাসনায় আমাদের বুদ্ধি হোক কল্যাণময়ী। হে অগ্নি, আমরা তোমার সখা হলে কেউ হিংসা করতে পারবে না।। (৬৭) দ্যুলোকের মস্তক, পৃথিবীর শাসক, বিশ্বনায়ক, সৎকর্মের প্রকাশক, কবি, সম্রাট, অতিথির ন্যায় পূজ্য, জনগণের মুখপাত্র অগ্নিদেবকে দেবগণ (-রশ্মিগণ) প্রকাশিত করেন।। (৬৮) বারিধারা যেমন পর্বতপৃষ্ঠকে সিক্ত করে সেরূপ হে অগ্নি, দেবতুল্য মানুষেরা তোমাকে সামগানে স্নান করান। হে স্তুতিবাহন, অশ্ব যেমন পথকে ব্যাপ্ত করে, সেই সুন্দর স্তুতিও তেমনি তোমাকে উজ্জ্বলরূপে ব্যাপ্ত করুক।। (৬৯) যজ্ঞের রাজা, রুদ্ররূপ, হোতা, দ্যুলোক-ভূলোকের সৎকর্মা, আদি অজ্ঞেয় মহানাদধ্বনি হতে হিরণ্যরূপে জাত অগ্নিকে তোমাদের রক্ষার জন্য উপাসনা কর।। (৭০) রাজা, ঈশ্বর স্তবের দ্বারা সম্যক্ দীপ্ত, যাঁর পূর্ণদর্শন ঘৃতের দ্বারা সংবর্ধিত, মানুষেরা আগ্রহের সঙ্গে হবির দ্বারা তাঁকে পূজা করে; অগ্নিদেব ঊষার আগে দীপ্তি লাভ করতে চলেছেন; কাছের আকাশ দূরের আকাশ তিনি ছেয়ে ফেললেন; জলের আধার আকাশে মহান বিদ্যুৎরূপে তিনি বর্ধিত হলেন।। (৭২) যিনি প্রশস্ত, দূরে দৃশ্যমান, গৃহপতি, দেবগণের উদ্দেশ্যে গমনশীল, সেই অগ্নিকে মানুষেরা আঙ্গুলের সাহায্যে অরণিকাষ্ঠ থেকে উৎপন্ন করেন (-প্রজ্জ্বালিত করেন)।।



অষ্টম খন্ডঃ মন্ত্রসংখ্যা ৮।। দেবতা অগ্নি; ৩ পূষা ।। ছন্দ ত্রিষ্টুপ ।। ঋষিঃ ১ আগ্নেয় বুধ ও গবিষ্টির, ২।৫ ভালদ্দন বৎসপ্রি; ৩ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, ৪।৭ গাথি বিশ্বামিত্র, ৬ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি, ৮ পায়ু ভারদ্বাজ।।

মন্ত্রঃ (৭৩) অবোধ্যগ্নিঃ সমিধা জনানাং প্রতি ধেনুমিবায়তীমুষাসম্। যহ্বা ইহ প্র বয়ামুজ্জিহানাঃ প্র ভানবঃ সস্রতে নাকমচ্ছ।।১।। (৭৪) প্র ভূর্জয়ন্তং মহাং বিপোধাং মূরৈরমূরং পুরাং দর্মাণম্। নয়ন্তং গীর্ভির্বনা ধিয়ং ধা হরিশ্মশ্রুং ন বর্মণা ধনর্চিম্।।২।। (৭৫) শুক্রং তে অন্যদ্যজতং তে অন্যদ্বিষুরূপে অহনী দ্যৌরিবাসি। বিশ্বা হি মায়া অবসি স্বধাবন্ ভত্রা তে পুষন্নিহ রাতিবস্তু।।৩।। (৭৬) ইড়ামগ্নে পুরুদংসং সনিং গোঃ শশ্বত্তমং হবমানায় সাধ। স্যান্নঃ সূনুস্তনয়ো বিজাবাগ্নে সা তে সুমতির্ভূত্বস্মে।।৪।। (৭৭) প্র হোতা জাতো মহান্নভো বিন্নৃষদ্মা সীদদপাং বিবর্তে। দধদ্যো ধায়ী সু তে বয়াংসি যন্তা বসূনি বিধতে তনূপাঃ।।৫।। (৭৮) প্র সম্রাজমসুরস্য প্রশস্তয়ং পুংসঃ কৃষ্টীনামনুমাদ্যস্য। ইন্দ্রস্যেব প্র তবসস্কৃতানি বদ্দদ্বারা বন্দমানা বিবষ্টু।।৬।। (৭৯) অরণ্যোর্নিহিতো জাতবেদ্য গর্ভ ইবেৎসুভৃতো গর্ভিণীভিঃ। দিবেদিব ঈড্যো জাগৃবদ্ভির্হবিষ্মিদ্ভির্মনুষো-ভিরগ্নিঃ।।৭।। (৮০) সনাদগ্নে মৃণসি যাতুধানান্ন ত্বা রক্ষাংসি পৃতনাসু জিণ্ড্যঃ। অনুদহ সহমূরান্ কয়াদো মা তে হেত্যা মুক্ষত দৈব্যায়াঃ।।৮।।

অনুবাদঃ (৭৩) ঊষাকালে দুগ্ধদাত্রী গাভীগণ যেমন মানুষের কাছে যায় অগ্নিও সেরূপ সমিধকাঠে প্রজ্জ্বালিত হন। তাঁর সেই মহান্ শিখাগুলি শাখাবিস্তারকারী বৃক্ষের মত দ্যুলোকের পানে ছুটে চলে। (৭৪) ভুবনজয়ী, প্রাণদ, মূঢের মত দৃষ্ট অথচ অবাধজ্ঞানসম্পন্ন, পুরনাশক, বেদবাণীর দ্বারা ভজনীয়, সর্বকর্মধারক শ্মশ্রুর মত উজ্জ্বল সুবর্ণশিখারূপ বর্মের দ্বারা আবৃত অগ্নিকে উত্তমরূপে স্তব কর। (৭৫) সে উদিতভানু পূষারূপী অগ্নি, তোমার এই যে লোহিতবর্ণ এ তোমার এক রূপ, আর যজ্ঞযোগ্য পূজনীয় তোমার যে রূপ তা অন্য; দিন ও রাত্রি সৃষ্টিরূপ কর্মের দ্বারা তুমি অন্তরিক্ষের মত বিশ্বব্যাপী। যে নিয়ন্তা, এই বিশ্বমায়ার তুমিই পালক; হে পূষা, তোমার এই দান কল্যাণময় হোক।। (৭৬) হে অগ্নি, তোমার উপাসকের জন্য বহুকর্মযুক্ত ধন ও শাশ্বতী বেদবাণী তুমি দিয়ে থাক। হে অগ্নি, আমাদের এমন পুত্র দাও যার থেকে বংশ বিস্তার হবে আর তোমার কল্যাণ আমাদের ওপর বর্ষিত হবে। (৭৭) অগ্নি মহান্ হয়ে হোতারূপে জাত হলেন, মানুষের মধ্যে নিবাস করলেন, জলের মধ্যে অবস্থান করলেন।। ওই মহাশূন্যে জন্মলাভ করে সকল কিছুই তিনি জানলেন আর সকল জীব ও ধনসম্পদের নিয়ামক হলেন।। (৭৮) প্রাণের দীপ্ত আধার, প্রশস্ত পৌরুষযুক্ত মানুষের পূজ্য, ইন্দ্রের মত বলশালী সেই প্রথমজাতকে স্তুতিদ্বারা বন্দনা কর।। (৭৯) গর্ভিণীর গর্ভে সুরক্ষিত ভাবে অবস্থিত প্রাণের মত দুই অরুণি কাঠের মধ্যে নিহিত আছেন জাতবেদা অগ্নি। যাঁরা নিজকর্মে সচেতন সেই হবির দাতা নরকূলে অগ্নি প্রতিদিন পূজিত।। (৮০) হে অগ্নি, যাদের হাত দুই অরণি কাঠের মধ্য মধ্য নিহিত আছেন জাতবেদা অগ্নি। যাঁরা, যাদের হাত থেকে জীবন রক্ষিতব্য তাদের ধ্বংস কর; তারা যেন তোমার ওপর জয়লাভ না করে; অপক্বমাংসভোজীগণ যেন তোমার দিব্য অস্ত্রের আঘাত থেকে মুক্তিলাভ না করে।।



নবম খন্ডঃ মন্ত্রসংখ্যা ১০; দেবতা অগ্নি ।। ছন্দ অনুষ্টুপ ।। ঋষিঃ ১ গয় আত্রেয়, ২ বামদেব, ৬।৪ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, ৫ দ্বিত মৃক্তবাহ্য আত্রেয়, ৩ অত্রিপুত্র বসুগণ, ৭।৯ গোপবন আত্রেয়, ৮ পুরু আত্রেয়, ১০ বামদেব কশ্যপ বা মারীচ অথবা বৈবস্বত মনু অথবা উভয়কৃত।।

মন্ত্রঃ (৮১) অগ্ন ওজিষ্ঠমা ভর দ্যুম্নমষ্মভ্যমধ্রিগো। প্র নো রায়ে পনীয়সে রৎসি বাজায় পন্থাম্‌।।১।। (৮২) যদি বীরো অনুষ্যাদগ্নিমিন্ধীত মর্ত্ত্যঃ। আজুহ্বধ্বব্যমানুষক্‌ শর্ম ভক্ষীত দৈব্যম্‌।।২।। (৮৩) ত্বেষস্তে ধূম ঋন্বতি দিবি সঞ্ছুক্রু আততঃ। সূরো ন দি দ্যুতা ত্বং কৃপা পাবক রোচসে।।৩।। (৮৪) ত্বং হি ক্ষৈতবদ্যশোহগ্নে মিত্র ন পত্যসে। ত্বং বিচর্ষণে শ্রবো পুষ্টিং ন পুষ্যতি।।৪।। (৮৫) প্রাতরগ্নিঃ পুরুপ্রিয়ো বিশ স্তবেতাতিথিঃ। বিশ্বে যস্মিন্নমর্ত্যে হব্যং মর্তাস ইন্ধতে।।৫।। (৮৬) যদ্‌ বাহিষ্ঠং তদগ্নয়ে বৃহদর্চ বিভাবসো। মহিষীব ত্বদ্‌ রয়িস্‌ত্বদ্‌ বাজা উদীরতে।।৬।। (৮০) বিশোবিশো বো অতিথিং বাজয়ন্তঃ পুরুপ্রিয়ম্‌। অগ্নিং বো দুর্যং বচঃ স্তুষে শুষস্য মন্মভিঃ।। ৭।। (৮৮) বৃহদ বয়ো হি ভাববেহর্চা দেবায়াগ্নয়ে। যং মিত্রং ন প্রশস্তয়ে মর্তাসো দধিরে পুরঃ।।৮।। (৮৯) অগন্ম বৃত্রহন্তনং জ্যেষ্ঠমগ্নিমানবম্‌ বৃহদনীক ইধ্যতে।।৯।। (৯০) জাতঃ পরেণ ধর্মণা যৎ সবৃদ্ধিঃ সহাভুবঃ। পিতা যৎ কশ্যপস্যাগ্নিঃ শ্রদ্ধা মাতা মনুঃ কবিঃ।।১০।।

অনুবাদঃ (৮১) হে অগ্নি, হে সদাগমনশীল, শ্রেষ্ঠ ধন বল প্রদান কর; গূঢ় বাক্যের দ্বারা বোধগম্য আশ্চর্যকর পরমধনের জন্য পথ নির্দেশ কর।। (৮২) মরণশীল মানুষ যদি বীর্যমান হয়ে নিরন্তর অগ্নিদেবকে উপাসনা করে তবেই দিব্যসুখ ও আশ্রয় লাভ করতে পারে।। (৮৩) হে পূত শুদ্ধ অগ্নি, তোমার মহান্‌ ধূম দ্যুলোকে গমন করে বারিরূপে ব্যাপ্ত হয়; তুমি নিজ সামর্থ্যে সূর্যের মত দীপ্ত হয়ে প্রকাশিত হও।। (৮৪) হে অগ্নি, রাজপুত্রের মত কান্তি তোমার, বন্ধুর মত আবিষ্ট কর; বিশ্বদ্রষ্টা তুমি হে বহুধন, যশ, আর পুষ্টি দিয়ে আমাদের পোষণ কর।। (৮৫) বিশ্বে যে অবিনশ্বরকে নশ্বর মানুষেরা হব্যদান ক'রে পূজা করে, তিনি জনগণের অতিথিবৎ পূজ্য, বহুপ্রিয়, প্রাতঃকালে পূজিত অগ্নিদেব।। (৮৬) উত্তম যে স্তব তা' অগ্নের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত। হে বিভাবসু, তোমা হতে বিপুল ধন ও অন্ন উৎপন্ন হয়।। (৮৭) সকল জনের অতিথি, বহুপ্রিয় অগ্নিকে অন্নকাম মানুষ তোমাদের জন্য আমি যথাশক্তি মননের দ্বারা দূর্জ্ঞেয় বাক্যে তুষ্ট করি।। (৮৮) মর্তের মানুষেরা স্তব ক'রে যে অগ্নিকে বন্ধুর মত পুরোভাগে স্থাপন করে, সেই দীপ্তশিখা অগ্নিদেবকে মহানন্দে অর্চনা কর।। (৮৯) যিনি মহান দীপ্তিতে ঋক্ষপুত্র শ্রুতর্বার কাছে প্রকাশিত হয়েছিলেন সেই প্রথমজাত, পাপনাশক, মানুষের হিতকর অগ্নিকে আমি জানি।। (৯০) যা উৎকৃষ্ট, পরম ধর্মজাত যা সকলের সঙ্গে মিলিত হয়ে বর্ধিত হয়, যে বিশ্বলোকের (=কশ্যপ) পালয়িতা, সেই অগ্নিই শ্রদ্ধা, মাতা, ক্রান্তদর্শী মনু। [ কশ্যপ=একপ্রকার আলোক যা সূর্যের ভ্রমণপথকে নিয়ন্ত্রিত করে ]।।দশম খন্ডঃ মন্ত্র সংখ্যা ৬।। দেবতাঃ ১ বিশ্বদেবগণ, ২ অঙ্গিরা, ৩-৬ অগ্নি।। ছন্দ অনুষ্টুপ।। ঋষিঃ ১ অগ্নিস্তাপস, ২।৩ বামদেব কশ্যপ বা অসিত দেবল, ৪ সোমাহুতি ভার্গব বা ভর্গাহুতি সোম ৫ পায়ু ভারদ্বাজ, ৬ প্রস্কন্ব কান্ব।।মন্ত্রঃ (৯১) সোমং রাজানং বরুণমগ্নিমন্বারভামহে। আদিত্যং বিষ্ণুং সূর্যং ব্রহ্মাণং চ বৃহস্পতিম্‌।।১।। (৯২) ইত এত উদারুহন্দিবঃ পৃষ্ঠান্যারুহন্‌। প্র ভুর্জয়ো যথা পথো দ্যামঙ্গিরসো যযুঃ।।২।। রায়ে আগ্নে মহে ত্বা দানায় সমিধিমহি। ঈড়িষ্বা হি মহে বৃষন্‌ দ্যাবা হোত্রায় পৃথিবী।।৩।। (৯৪) দধন্বে বা যদীমনু বোচদ্‌ ব্রহ্মেতি বেরু তৎ। পরি বিশ্বানি কাব্যা নেমিশ্চক্রমিবাভুবৎ।।৪।। (৯৫) প্রত্যগ্নে হরসা হরঃ শৃণাহি বিশ্বতস্পরি। যাতুধানস্য রক্ষস্যে বলং ব্যুব্জবীর্যম্‌।।৫।। (৯৬) তমগ্নে বসুঁরিহ রুদ্রাঁ আদিত্যাঁ উত। যজা স্বধ্বরং জনং মনুজাতং ঘৃতপ্রুষম্‌।।৬।।

অনুবাদঃ (৯১) আমাদের রক্ষার জন্য আমরা সোমরাজাকে, বরুণ অগ্নিকে আহ্বান করি; আর আহ্বান করি আদিত্য বিষ্ণু, সুর্য, ব্রহ্মা ও বৃহস্পতিকে।। (৯২) পৃথিবীবিজয়ী রাজা যে পথে দিব্যধামে গমন করেন আঙ্গিরাগণও সেই পথে দ্যুলোকে গমন করেন।। (৯৩) হে অগ্নি, শ্রেষ্ঠ ধনলাভের জন্য তোমাকে সন্দীপ্ত করি। হে বর্ষণকারী, মহান্‌ আহুতিকর্মের জন্য দ্যুলোক ও ভূলোককে প্রশংসিত কর।। (৯৪) যজ্ঞে উপাসক যে হব্য দান করেন, যে মন্ত্র উচ্চারণ করেন ব্রহ্মস্বরূপ অগ্নি তা সমস্তই জানেন। নেমি যেমন চক্রকে ব্যাপ্ত করে বর্তমান থাকে অগ্নিও সেরূপ উপাসকের সমস্ত কর্মই ব্যাপ্ত করে আছেন।। (৯৬) হে অগ্নি, তোমার তেজের দ্বারা হিংসকের বল নষ্ট কর, বিঘ্নকারীর বলবীর্য ভেঙে দাও।। (৯৬) হে অগ্নি, এই যজ্ঞে বসু, রুদ্র ও আদিত্যদের অর্চনা কর; সোভন যজ্ঞযুক্ত ও বৃষ্টিপ্রদানকারী মনুজাতদেরও ভজনা কর।। 

নবম খন্ডঃ মন্ত্রসংখ্যা ১০; দেবতা অগ্নি ।। ছন্দ অনুষ্টুপ ।। ঋষিঃ ১ গয় আত্রেয়, ২ বামদেব, ৬।৪ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, ৫ দ্বিত মৃক্তবাহ্য আত্রেয়, ৩ অত্রিপুত্র বসুগণ, ৭।৯ গোপবন আত্রেয়, ৮ পুরু আত্রেয়, ১০ বামদেব কশ্যপ বা মারীচ অথবা বৈবস্বত মনু অথবা উভয়কৃত।।

মন্ত্রঃ (৮১) অগ্ন ওজিষ্ঠমা ভর দ্যুম্নমষ্মভ্যমধ্রিগো। প্র নো রায়ে পনীয়সে রৎসি বাজায় পন্থাম্‌।।১।। (৮২) যদি বীরো অনুষ্যাদগ্নিমিন্ধীত মর্ত্ত্যঃ। আজুহ্বধ্বব্যমানুষক্‌ শর্ম ভক্ষীত দৈব্যম্‌।।২।। (৮৩) ত্বেষস্তে ধূম ঋন্বতি দিবি সঞ্ছুক্রু আততঃ। সূরো ন দি দ্যুতা ত্বং কৃপা পাবক রোচসে।।৩।। (৮৪) ত্বং হি ক্ষৈতবদ্যশোহগ্নে মিত্র ন পত্যসে। ত্বং বিচর্ষণে শ্রবো পুষ্টিং ন পুষ্যতি।।৪।। (৮৫) প্রাতরগ্নিঃ পুরুপ্রিয়ো বিশ স্তবেতাতিথিঃ। বিশ্বে যস্মিন্নমর্ত্যে হব্যং মর্তাস ইন্ধতে।।৫।। (৮৬) যদ্‌ বাহিষ্ঠং তদগ্নয়ে বৃহদর্চ বিভাবসো। মহিষীব ত্বদ্‌ রয়িস্‌ত্বদ্‌ বাজা উদীরতে।।৬।। (৮০) বিশোবিশো বো অতিথিং বাজয়ন্তঃ পুরুপ্রিয়ম্‌। অগ্নিং বো দুর্যং বচঃ স্তুষে শুষস্য মন্মভিঃ।। ৭।। (৮৮) বৃহদ বয়ো হি ভাববেহর্চা দেবায়াগ্নয়ে। যং মিত্রং ন প্রশস্তয়ে মর্তাসো দধিরে পুরঃ।।৮।। (৮৯) অগন্ম বৃত্রহন্তনং জ্যেষ্ঠমগ্নিমানবম্‌ বৃহদনীক ইধ্যতে।।৯।। (৯০) জাতঃ পরেণ ধর্মণা যৎ সবৃদ্ধিঃ সহাভুবঃ। পিতা যৎ কশ্যপস্যাগ্নিঃ শ্রদ্ধা মাতা মনুঃ কবিঃ।।১০।।

অনুবাদঃ (৮১) হে অগ্নি, হে সদাগমনশীল, শ্রেষ্ঠ ধন বল প্রদান কর; গূঢ় বাক্যের দ্বারা বোধগম্য আশ্চর্যকর পরমধনের জন্য পথ নির্দেশ কর।। (৮২) মরণশীল মানুষ যদি বীর্যমান হয়ে নিরন্তর অগ্নিদেবকে উপাসনা করে তবেই দিব্যসুখ ও আশ্রয় লাভ করতে পারে।। (৮৩) হে পূত শুদ্ধ অগ্নি, তোমার মহান্‌ ধূম দ্যুলোকে গমন করে বারিরূপে ব্যাপ্ত হয়; তুমি নিজ সামর্থ্যে সূর্যের মত দীপ্ত হয়ে প্রকাশিত হও।। (৮৪) হে অগ্নি, রাজপুত্রের মত কান্তি তোমার, বন্ধুর মত আবিষ্ট কর; বিশ্বদ্রষ্টা তুমি হে বহুধন, যশ, আর পুষ্টি দিয়ে আমাদের পোষণ কর।। (৮৫) বিশ্বে যে অবিনশ্বরকে নশ্বর মানুষেরা হব্যদান ক'রে পূজা করে, তিনি জনগণের অতিথিবৎ পূজ্য, বহুপ্রিয়, প্রাতঃকালে পূজিত অগ্নিদেব।। (৮৬) উত্তম যে স্তব তা' অগ্নের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত। হে বিভাবসু, তোমা হতে বিপুল ধন ও অন্ন উৎপন্ন হয়।। (৮৭) সকল জনের অতিথি, বহুপ্রিয় অগ্নিকে অন্নকাম মানুষ তোমাদের জন্য আমি যথাশক্তি মননের দ্বারা দূর্জ্ঞেয় বাক্যে তুষ্ট করি।। (৮৮) মর্তের মানুষেরা স্তব ক'রে যে অগ্নিকে বন্ধুর মত পুরোভাগে স্থাপন করে, সেই দীপ্তশিখা অগ্নিদেবকে মহানন্দে অর্চনা কর।। (৮৯) যিনি মহান দীপ্তিতে ঋক্ষপুত্র শ্রুতর্বার কাছে প্রকাশিত হয়েছিলেন সেই প্রথমজাত, পাপনাশক, মানুষের হিতকর অগ্নিকে আমি জানি।। (৯০) যা উৎকৃষ্ট, পরম ধর্মজাত যা সকলের সঙ্গে মিলিত হয়ে বর্ধিত হয়, যে বিশ্বলোকের (=কশ্যপ) পালয়িতা, সেই অগ্নিই শ্রদ্ধা, মাতা, ক্রান্তদর্শী মনু। [ কশ্যপ=একপ্রকার আলোক যা সূর্যের ভ্রমণপথকে নিয়ন্ত্রিত করে ]।।

দশম খন্ডঃ মন্ত্র সংখ্যা ৬।। দেবতাঃ ১ বিশ্বদেবগণ, ২ অঙ্গিরা, ৩-৬ অগ্নি।। ছন্দ অনুষ্টুপ।। ঋষিঃ ১ অগ্নিস্তাপস, ২।৩ বামদেব কশ্যপ বা অসিত দেবল, ৪ সোমাহুতি ভার্গব বা ভর্গাহুতি সোম ৫ পায়ু ভারদ্বাজ, ৬ প্রস্কন্ব কান্ব।।

মন্ত্রঃ (৯১) সোমং রাজানং বরুণমগ্নিমন্বারভামহে। আদিত্যং বিষ্ণুং সূর্যং ব্রহ্মাণং চ বৃহস্পতিম্‌।।১।। (৯২) ইত এত উদারুহন্দিবঃ পৃষ্ঠান্যারুহন্‌। প্র ভুর্জয়ো যথা পথো দ্যামঙ্গিরসো যযুঃ।।২।। রায়ে আগ্নে মহে ত্বা দানায় সমিধিমহি। ঈড়িষ্বা হি মহে বৃষন্‌ দ্যাবা হোত্রায় পৃথিবী।।৩।। (৯৪) দধন্বে বা যদীমনু বোচদ্‌ ব্রহ্মেতি বেরু তৎ। পরি বিশ্বানি কাব্যা নেমিশ্চক্রমিবাভুবৎ।।৪।। (৯৫) প্রত্যগ্নে হরসা হরঃ শৃণাহি বিশ্বতস্পরি। যাতুধানস্য রক্ষস্যে বলং ব্যুব্জবীর্যম্‌।।৫।। (৯৬) তমগ্নে বসুঁরিহ রুদ্রাঁ আদিত্যাঁ উত। যজা স্বধ্বরং জনং মনুজাতং ঘৃতপ্রুষম্‌।।৬।।অনুবাদঃ (৯১) আমাদের রক্ষার জন্য আমরা সোমরাজাকে, বরুণ অগ্নিকে আহ্বান করি; আর আহ্বান করি আদিত্য বিষ্ণু, সুর্য, ব্রহ্মা ও বৃহস্পতিকে।। (৯২) পৃথিবীবিজয়ী রাজা যে পথে দিব্যধামে গমন করেন আঙ্গিরাগণও সেই পথে দ্যুলোকে গমন করেন।। (৯৩) হে অগ্নি, শ্রেষ্ঠ ধনলাভের জন্য তোমাকে সন্দীপ্ত করি। হে বর্ষণকারী, মহান্‌ আহুতিকর্মের জন্য দ্যুলোক ও ভূলোককে প্রশংসিত কর।। (৯৪) যজ্ঞে উপাসক যে হব্য দান করেন, যে মন্ত্র উচ্চারণ করেন ব্রহ্মস্বরূপ অগ্নি তা সমস্তই জানেন। নেমি যেমন চক্রকে ব্যাপ্ত করে বর্তমান থাকে অগ্নিও সেরূপ উপাসকের সমস্ত কর্মই ব্যাপ্ত করে আছেন।। (৯৬) হে অগ্নি, তোমার তেজের দ্বারা হিংসকের বল নষ্ট কর, বিঘ্নকারীর বলবীর্য ভেঙে দাও।। (৯৬) হে অগ্নি, এই যজ্ঞে বসু, রুদ্র ও আদিত্যদের অর্চনা কর; সোভন যজ্ঞযুক্ত ও বৃষ্টিপ্রদানকারী মনুজাতদেরও ভজনা কর।। 


নবম খন্ডঃ মন্ত্রসংখ্যা ১০; দেবতা অগ্নি ।। ছন্দ অনুষ্টুপ ।। ঋষিঃ ১ গয় আত্রেয়, ২ বামদেব, ৬।৪ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, ৫ দ্বিত মৃক্তবাহ্য আত্রেয়, ৩ অত্রিপুত্র বসুগণ, ৭।৯ গোপবন আত্রেয়, ৮ পুরু আত্রেয়, ১০ বামদেব কশ্যপ বা মারীচ অথবা বৈবস্বত মনু অথবা উভয়কৃত।।

মন্ত্রঃ (৮১) অগ্ন ওজিষ্ঠমা ভর দ্যুম্নমষ্মভ্যমধ্রিগো। প্র নো রায়ে পনীয়সে রৎসি বাজায় পন্থাম্‌।।১।। (৮২) যদি বীরো অনুষ্যাদগ্নিমিন্ধীত মর্ত্ত্যঃ। আজুহ্বধ্বব্যমানুষক্‌ শর্ম ভক্ষীত দৈব্যম্‌।।২।। (৮৩) ত্বেষস্তে ধূম ঋন্বতি দিবি সঞ্ছুক্রু আততঃ। সূরো ন দি দ্যুতা ত্বং কৃপা পাবক রোচসে।।৩।। (৮৪) ত্বং হি ক্ষৈতবদ্যশোহগ্নে মিত্র ন পত্যসে। ত্বং বিচর্ষণে শ্রবো পুষ্টিং ন পুষ্যতি।।৪।। (৮৫) প্রাতরগ্নিঃ পুরুপ্রিয়ো বিশ স্তবেতাতিথিঃ। বিশ্বে যস্মিন্নমর্ত্যে হব্যং মর্তাস ইন্ধতে।।৫।। (৮৬) যদ্‌ বাহিষ্ঠং তদগ্নয়ে বৃহদর্চ বিভাবসো। মহিষীব ত্বদ্‌ রয়িস্‌ত্বদ্‌ বাজা উদীরতে।।৬।। (৮০) বিশোবিশো বো অতিথিং বাজয়ন্তঃ পুরুপ্রিয়ম্‌। অগ্নিং বো দুর্যং বচঃ স্তুষে শুষস্য মন্মভিঃ।। ৭।। (৮৮) বৃহদ বয়ো হি ভাববেহর্চা দেবায়াগ্নয়ে। যং মিত্রং ন প্রশস্তয়ে মর্তাসো দধিরে পুরঃ।।৮।। (৮৯) অগন্ম বৃত্রহন্তনং জ্যেষ্ঠমগ্নিমানবম্‌ বৃহদনীক ইধ্যতে।।৯।। (৯০) জাতঃ পরেণ ধর্মণা যৎ সবৃদ্ধিঃ সহাভুবঃ। পিতা যৎ কশ্যপস্যাগ্নিঃ শ্রদ্ধা মাতা মনুঃ কবিঃ।।১০।।

অনুবাদঃ (৮১) হে অগ্নি, হে সদাগমনশীল, শ্রেষ্ঠ ধন বল প্রদান কর; গূঢ় বাক্যের দ্বারা বোধগম্য আশ্চর্যকর পরমধনের জন্য পথ নির্দেশ কর।। (৮২) মরণশীল মানুষ যদি বীর্যমান হয়ে নিরন্তর অগ্নিদেবকে উপাসনা করে তবেই দিব্যসুখ ও আশ্রয় লাভ করতে পারে।। (৮৩) হে পূত শুদ্ধ অগ্নি, তোমার মহান্‌ ধূম দ্যুলোকে গমন করে বারিরূপে ব্যাপ্ত হয়; তুমি নিজ সামর্থ্যে সূর্যের মত দীপ্ত হয়ে প্রকাশিত হও।। (৮৪) হে অগ্নি, রাজপুত্রের মত কান্তি তোমার, বন্ধুর মত আবিষ্ট কর; বিশ্বদ্রষ্টা তুমি হে বহুধন, যশ, আর পুষ্টি দিয়ে আমাদের পোষণ কর।। (৮৫) বিশ্বে যে অবিনশ্বরকে নশ্বর মানুষেরা হব্যদান ক'রে পূজা করে, তিনি জনগণের অতিথিবৎ পূজ্য, বহুপ্রিয়, প্রাতঃকালে পূজিত অগ্নিদেব।। (৮৬) উত্তম যে স্তব তা' অগ্নের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত। হে বিভাবসু, তোমা হতে বিপুল ধন ও অন্ন উৎপন্ন হয়।। (৮৭) সকল জনের অতিথি, বহুপ্রিয় অগ্নিকে অন্নকাম মানুষ তোমাদের জন্য আমি যথাশক্তি মননের দ্বারা দূর্জ্ঞেয় বাক্যে তুষ্ট করি।। (৮৮) মর্তের মানুষেরা স্তব ক'রে যে অগ্নিকে বন্ধুর মত পুরোভাগে স্থাপন করে, সেই দীপ্তশিখা অগ্নিদেবকে মহানন্দে অর্চনা কর।। (৮৯) যিনি মহান দীপ্তিতে ঋক্ষপুত্র শ্রুতর্বার কাছে প্রকাশিত হয়েছিলেন সেই প্রথমজাত, পাপনাশক, মানুষের হিতকর অগ্নিকে আমি জানি।। (৯০) যা উৎকৃষ্ট, পরম ধর্মজাত যা সকলের সঙ্গে মিলিত হয়ে বর্ধিত হয়, যে বিশ্বলোকের (=কশ্যপ) পালয়িতা, সেই অগ্নিই শ্রদ্ধা, মাতা, ক্রান্তদর্শী মনু। [ কশ্যপ=একপ্রকার আলোক যা সূর্যের ভ্রমণপথকে নিয়ন্ত্রিত করে ]।।


দশম খন্ডঃ মন্ত্র সংখ্যা ৬।। দেবতাঃ ১ বিশ্বদেবগণ, ২ অঙ্গিরা, ৩-৬ অগ্নি।। ছন্দ অনুষ্টুপ।। ঋষিঃ ১ অগ্নিস্তাপস, ২।৩ বামদেব কশ্যপ বা অসিত দেবল, ৪ সোমাহুতি ভার্গব বা ভর্গাহুতি সোম ৫ পায়ু ভারদ্বাজ, ৬ প্রস্কন্ব কান্ব।।

মন্ত্রঃ (৯১) সোমং রাজানং বরুণমগ্নিমন্বারভামহে। আদিত্যং বিষ্ণুং সূর্যং ব্রহ্মাণং চ বৃহস্পতিম্‌।।১।। (৯২) ইত এত উদারুহন্দিবঃ পৃষ্ঠান্যারুহন্‌। প্র ভুর্জয়ো যথা পথো দ্যামঙ্গিরসো যযুঃ।।২।। রায়ে আগ্নে মহে ত্বা দানায় সমিধিমহি। ঈড়িষ্বা হি মহে বৃষন্‌ দ্যাবা হোত্রায় পৃথিবী।।৩।। (৯৪) দধন্বে বা যদীমনু বোচদ্‌ ব্রহ্মেতি বেরু তৎ। পরি বিশ্বানি কাব্যা নেমিশ্চক্রমিবাভুবৎ।।৪।। (৯৫) প্রত্যগ্নে হরসা হরঃ শৃণাহি বিশ্বতস্পরি। যাতুধানস্য রক্ষস্যে বলং ব্যুব্জবীর্যম্‌।।৫।। (৯৬) তমগ্নে বসুঁরিহ রুদ্রাঁ আদিত্যাঁ উত। যজা স্বধ্বরং জনং মনুজাতং ঘৃতপ্রুষম্‌।।৬।।

অনুবাদঃ (৯১) আমাদের রক্ষার জন্য আমরা সোমরাজাকে, বরুণ অগ্নিকে আহ্বান করি; আর আহ্বান করি আদিত্য বিষ্ণু, সুর্য, ব্রহ্মা ও বৃহস্পতিকে।। (৯২) পৃথিবীবিজয়ী রাজা যে পথে দিব্যধামে গমন করেন আঙ্গিরাগণও সেই পথে দ্যুলোকে গমন করেন।। (৯৩) হে অগ্নি, শ্রেষ্ঠ ধনলাভের জন্য তোমাকে সন্দীপ্ত করি। হে বর্ষণকারী, মহান্‌ আহুতিকর্মের জন্য দ্যুলোক ও ভূলোককে প্রশংসিত কর।। (৯৪) যজ্ঞে উপাসক যে হব্য দান করেন, যে মন্ত্র উচ্চারণ করেন ব্রহ্মস্বরূপ অগ্নি তা সমস্তই জানেন। নেমি যেমন চক্রকে ব্যাপ্ত করে বর্তমান থাকে অগ্নিও সেরূপ উপাসকের সমস্ত কর্মই ব্যাপ্ত করে আছেন।। (৯৬) হে অগ্নি, তোমার তেজের দ্বারা হিংসকের বল নষ্ট কর, বিঘ্নকারীর বলবীর্য ভেঙে দাও।। (৯৬) হে অগ্নি, এই যজ্ঞে বসু, রুদ্র ও আদিত্যদের অর্চনা কর; সোভন যজ্ঞযুক্ত ও বৃষ্টিপ্রদানকারী মনুজাতদেরও ভজনা কর।।

একাদশ খন্ড।। মন্ত্র সংখ্যা ১০।। দেবতা অগ্নি; ৫ পবমান সোম; ৬ অদিতি।। ছন্দ ঊষ্ণিক্‌।। ঋষিঃ ১ দীর্ঘতমা ঔচথা, ২।৪ গাথি বিশ্বামিত্র, ৩ গোতম রাহুগণ, ৫ ত্রিত আপ্ত্য, ৬ ইরিম্বিঠি কান্ব, ৭।৮।১০ বিশ্বমনা বৈয়শ্ব, ৮ ঋজিশ্বা ভারদ্বাজ।।

মন্ত্রঃ (৯৭) পুরু ত্বা দাশিবাং বোচেহরিরগ্নে তব স্বিদা। তোদস্যেব শরণ আ মহস্য।।১।। (৯৮) প্র হোত্রে পূর্ব্যং বচোহগ্নয়ে ভরতা বৃহৎ। বিপাং জ্যোতীংষি বিভ্রতে ব বেধসে।।২।। (৯৯) অগ্নে বাজস্য গোমত ঈশানঃ সহসো যহো। অস্মে দেহি জাতবেদো মহি শ্রবঃ।।৩।। (১০০) অগ্নে যজিষ্ঠো অধ্বরে দেবান্‌ দেবয়তে যজ। হোতা মন্দ্রো বি রাজস্যতি স্রিধঃ।।৪।। (১০১) জজ্ঞানঃ সপ্ত মাতৃভির্মেধামাশাসত শ্রিয়ে। অয়ং ধ্রুবো রয়ীণাং চিকেতদা।।৫।। (১০২) উত স্যা নো দিবা মাতরদিতিরূত্যাগমৎ। সা শন্তানা ময়স্করদপ স্রিধঃ।।৬।। (১০৩) ঈদিষ্বা হি প্রতীব্যাংত যজস্ব জাতবেদসম্‌। চরিষ্ণু ধূমমগৃভীতশোচিষম।।৭।। (১০৪) ন তস্য মায়য়া চ ন রিপুরীশীত মর্ত্যঃ। যো অগ্নয়ে দদাশ হব্যদাতয়ে।।৮।। (১০৫) অপ ত্যং বৃজিনং রিপুং স্তেনমগ্নে দুরাধ্যম্‌। দবিশ্বমস্য সয়পতে কৃধী সুগম্‌।।৯।। (১০৬) শ্রুষ্ট্যগ্নে নবস্য মে স্তোমস্য বীর বিশ্‌পতে। নি মায়িনস্তপসা রক্ষস্যে দহ।।১০।।

অনুবাদঃ (৯৭) হে অগ্নি, আমি তোমার উদ্দেশে অনেক হব্য দান ক'রে তোমার কাছে অনেক কামনা করি। হে অগ্নি, মহান্‌ প্রভুর গৃহে যেমন সেবক থাকে, আমিও তোমার তেমনি সেবক।। (৯৮) হে নরগণ, মেধাসম্পন্নদের তেজ ধারণকারী জগৎনিয়ন্তা, দেবগণের আহ্বানকারী অগ্নিদেবের উদ্দেশে মহান সনাতন বাণী উচ্চারণ কর। (৯৯) হে অগ্নি, তুমি বলজাত, তুমি বাক্‌, বল ও অন্নের ঈশ্বর; হে জাতবেদা, আমাদের মহান প্রখ্যাত অন্ন বল দাও। (১০০) হে অগ্নি, তুমি যজ্ঞকারিগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যাজ্ঞিক, যারা দেবকাম তাদের জন্য তুমি দেবতাদের মিলিত কর; তুমি হোতা আনন্দময়, তুমি অবিশ্বাসীকে পরাভূত ক'রে বিরাজ কর। (১০১) সোম যখন জন্মালেন তখন সপ্তমাতারূপিণী সপ্তছন্দ সৌন্দর্যের জন্য সোমকে ঘিরে স্তব করতে লাগলেন, কারণ তিনি সর্বজ্ঞ, আর তিনিই নিশ্চিত ধনের সন্ধান জানেন। (১০২) সেই অখন্ড মননশক্তি আমাদের নিত্য রক্ষার জন্য আগমন করুন; তিনি আমাদের শান্তিকর সুখ বিধান করুন, বিঘ্ন নাশ করুন।।১০৩।। যিনি বিঘ্ননাশকারী, জাতবেদা, যাঁর ধূম সর্বত্র সঞ্চারিত, যাঁর তেজ কেহ গ্রহন করতে পারে না, সেই অগ্নিকে স্তব কর, পূজা কর।। (১০৪) যিনি কর্মফলদাতা অগ্নির উদ্দেশে দান করেন তার শত্রু কোন প্রকার মায়াদ্বারা তার কোন ক্ষতি করতে পারে না।। (১০৫) হে অগ্নি, সেই কুটিলপথগামীকে, শত্রুকে, চোরকে, দারিদ্র্যকে নাশ কর। হে সজ্জনপালক, এই সমস্ত দূর ক'রে আমাদের সুপথগামী কর।। (১০৬) হে বীর, হে জনগণপালক, আমার এই নতুন স্ত্রোত্র শুনে মায়াসৃষ্টিকারী বিঘ্নকারক শক্তিকে তোমার তপের তাপে দহন কর।।

দ্বাদশ খন্ডঃ মন্ত্র সংখ্যা ৮।। দেবতা অগ্নি।। ছন্দ ১-৭, ককূপ, ৮ ঊষ্ণিক।। ঋষিঃ ১।৪ প্রয়োগ ভার্গব অথবা সৌভরি কান্ব, ২।৩।৫।৬।৭ সৌভরি কান্ব, ৮ বিশ্বমনা বৈয়শ্ব।।
মন্ত্রঃ (১০৭) প্র মংহিষ্ঠায় গায়ত ঋতাব্নে বৃহতে শুক্রশোচিষে। উপস্তুতাসো অগ্নয়ে।।১।। (১০৮) প্র সো অগ্নে তবোতিভিঃ সুবীরাভিস্তরতি বাজকর্মভিঃ। যস্য ত্বং সখ্যমাবিথ।।২।। (১০৯) তং গূর্ধয়া স্বর্ণরং দেবাসো দেবমরতিং দধন্বিরে। দেবত্রা হব্যমুহিষে।।৩।। (১১০) মা নো হৃণীথা অতিথিং বসুরগ্নিঃ পুরুপ্রশস্ত এষঃ। যঃ সুহোভা স্বধ্বরঃ।।৪।। (১১১) ভদ্রো নো অগ্নিরাহুতে ভদ্রা রাতিঃ সুভগ ভদ্রো অধ্বরঃ। ভদ্রা উত প্রশস্তয়ঃ।।৫।। (১১২) যজিষ্ঠং ত্বা ববৃমহে দেবং দেবত্রা হোতারমমর্ত্যম্‌। অস্য যজ্ঞস্য সুক্রতুম্‌।।৬।। (১১৩) তদগ্নে দ্যুন্মমা ভর যৎসাসাহা সদনে কঞ্চিদত্রিণম্‌। মন্যুং জনস্য দূঢ্যম্‌।।৭।। (১১৪) যদ্বা উ বিশ্‌পতিঃ শিতঃ সুপ্রীতো মনুষো বিশে। বিশ্বেদগ্নিঃ প্রতি রক্ষাংসি সেধতি।।
অনুবাদঃ
 (১০৭) হে স্তোতাগণ, তোমরা শ্রেষ্ঠদাতা, সত্যধর্মা, মহান, পবিত্র দীপ্তিময় অগ্নির উদ্দেশে গান কর।। (১০৮) হে অগ্নি, তুমি যাকে সখা কর সে তোমার দেওয়া উত্তম বল ও অন্নদ্বারা সকল বিঘ্ন অতিক্রম করে।। (১০৯) হে স্তোতা, যিনি দ্যুলোকে হব্য নিয়ে যান সেই প্রসিদ্ধ অগ্নির স্তব কর; বিদ্বান্‌গণ তাঁরই কাছে গমন করেন এবং তাঁর মাধ্যমে দেবগণকে হব্য প্রদান করেন।। (১১০) যিনি দেবগণের উত্তম আহ্বানকারী, যিনি সুযাজ্ঞিক সেই অতিপ্রশস্ত ধনপ্রদ অতিথি অগ্নি যেন আমাদের অনাদর না করেন।। (১১১) সম্যক্‌ পূজিত অগ্নি আমাদের জন্য কল্যাণকর হোন; হে শোভনধন অগ্নি, তোমার দান আমাদের কল্যাণ করুক; এই অহিংসিত যজ্ঞ কল্যাণময় হোক; আমাদের স্তুতি কল্যাণকর হোক; (১১২) হে অগ্নি, তুমি শ্রেষ্ঠ যাজ্ঞিক, দেবগণের দেব, তুমি হোতা, তুমি অমর; এই যজ্ঞের সুকর্মা তোমাকে আমরা বরণ করি।। (১১৩) হে অগ্নি, আমাদের সেই ধন দাও যে ধন গৃহে প্রবিষ্ট দুষ্ট বিধ্নকারীকে পরাভূত করে ও পাপবুদ্ধি ব্যক্তির ক্রোধ অভিভূত করে। (১১৪) জনগণের পালক তীক্ষ্ণ অগ্নি প্রীত হয়ে যখন গৃহে অবস্থান করেন তখন তিনি সকল বিঘ্ন সমূলে বিনাশ করেন।।
 

সামবেদ ভূমিকাঃ

সামবেদ ভূমিকাঃ

'বেদ' শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হলেও বেদ সন্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতা পর্বত প্রমাণ। বেদ বিদ্যা দুইপ্রকার, পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা।

যে বিদ্যার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বিদ্যা আর কিছু নেই, যে বিদ্যার সন্ধান পেলে আর কিছুই জানার বাকী থাকে না তা পরাবিদ্যা। কি সেই জ্ঞান যা জানলে পরে আর কিছুই জানার বাকী থাকে না? সে জ্ঞান বিশ্ব জ্ঞান। এই বিশ্বজ্ঞান কাকে আশ্রয় করে আছে? এই বিশ্বজ্ঞান স্বয়ং প্রকাশ। ইনি স্ব-ইচ্ছায় জাত হয়েছেন। ইনি স্ব-ইচ্ছায় কর্ম করে থাকেন। ইনি তাই আত্মজন্ম ও আত্মকর্মা। ইনি কখন জাত হলেন? ইনি যখন জাত হলেন তাঁর পূর্বে কি ছিল? ইনি যখন জাত হলেন তখন তাঁর পুর্বে তিনি ছিলেন সেই বস্তুর দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে যে বস্তুর অস্তিত্ব ছিল না আর সমস্ত কিছুই চিহ্ন বর্জিত ছিল। তখন যা নেই তাও ছিল না, যা আছে তাও ছিল না। তখন মৃত্যুও ছিল না, অমরত্বও ছিল না। রাত্রী ও দিনের প্রভেদ ছিল না। তখন কেবলমাত্র সেই বস্তু যিনি আত্মজন্ম, স্বয়ম্ভু আত্মা, তিনি বায়ুশূন্য প্রাণনক্রিয়া করছিলেন, আর তাঁর যে অবিদ্যমান বস্তু স্বীয় মায়া বা প্রজ্ঞা, তার সঙ্গে অবিভাগাপন্ন ছিলেন। তাই আত্মা ব্রহ্ম তখন সৎও ছিলেন না, অসৎও ছিলেন না। কেবলমাত্র স্বীয় মায়ার সঙ্গে অবিনাভাবে অতি ক্ষুদ্ররূপে, যার চেয়ে আর ক্ষুদ্র কিছু হয় না, সেইভাবে অবস্থান করে বায়ুশূন্য প্রাণনক্রিয়া সহায়ে নিজেই নিজের মায়া সহকারে নিজে নিজেই জ্বলছিলেন। তিনি আত্মজন্ম বলে তাঁর মায়ারূপ প্রজ্ঞা কর্মকে ইচ্ছা করলো। তখন তাঁর ইচ্ছাকে তিনি বর্ধিত করলেন, অবিনাভাব মায়াকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি ঊর্ধ্বগতিযুক্ত হলেন। এই ঊর্ধ্বগতি হওয়ার ইচ্ছামাত্রই তাঁর প্রাণশক্তির বল বৃদ্ধি পেল। এই বৃদ্ধির ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে যেমন আকাশ সৃষ্টি হোল তাঁর বলকার্যকে ধারণ করার জন্য, তেমনি তাঁর বৃদ্ধি পাবার ইচ্ছা মাত্রই তিনি গতিযুক্ত হলেন। তিনি অগিযুক্ত বা গতিযুক্ত (অগি ধাতু গতি অর্থে) হয়ে তার বৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন। তাই তিনি হলেন 'অগ্নি'। তাঁর এই বৃদ্ধি শিখাযুক্ত হোল গার তা হোল ঊর্ধ্বগতিযুক্ত। তিনি ছিলেন 'দহর' অতি ক্ষুদ্র, এখন হলেন 'অগ্নি' সব কিছুকেই এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য; বহন করবার জন্য; এবং সকলের আগে সকল কর্মে আগে আগে থাকবার জন্য। আর তিনি যে অগ্নিরূপে বৃদ্ধি পেতে লাগলেন সেই বৃদ্ধি ক্ষণস্থায়ী হোল না। অনন্তকাল ধরে তিনি বেড়ে চললেন। তিনি ঊর্ধ্বগতিযুক্ত হলে, তাঁর রশ্মিসকল ঊর্ধ্বগতিযুক্ত হলে, তার সেই বলকার্যকে ধারণ করার জন্য যে মহাশূন্য মহাকাশ সৃষ্টি হয়েছিল সেই মহাকাশে মহাশূন্য সেই ঊর্ধ্বগতিযুক্ত রশ্মিসকল শয়ন করলো। আর সেই মহাশূন্যে রশ্মিরা শয়ন করে নমিত হয়ে পড়লো আর শুভ্র জ্যোতি ধারণ করলো। এই যে জ্যোতির্ময় ব্রহ্ম এ অবিনাশী অক্ষয় সনাতন। আর এই জ্যোতির মধ্যেই সমস্ত ভুবন সমস্ত লোক আশ্রিত। এঁকে অতিক্রম করে যেতে পারে এমন কোন বস্তু এ ভুবনে নেই। এই যে জ্যোতির্ময় ব্রহ্মরূপে আত্মা এর জ্যোতি হিরণ্যময়। মহাশূন্যে মহাকাশে ইনি হিরন্ময় জ্যোতিরূপে স্বীয় মায়ারূপ প্রজ্ঞার দ্বারা ব্যাপ্ত হয়ে নিজের মধ্যেই আহার ঘুরে এলেন অন্ডাকৃতি ধারণ করে। অন্ডের মধ্যের জীব যেমন আহরণের মধ্যে থেকে প্রাণননক্রিয়া করে যেতে থাকে ইনিও তেমন হিরণ্ময় আবরণসুক্ত অন্ডাকৃতি ধারণ করে এই বিশাল ব্রহ্মান্ডের মধ্যে প্রাণনক্রিয়ায় ব্যাপ্ত রইলেন স্বীয় মায়ারূপ প্রজ্ঞার সঙ্গে অবিভাগাপন্ন হয়ে ঠিক সেইভাবে যখন তিনি সৃষ্টির প্রারম্ভে অবিদ্যমান মায়াবস্তুর সঙ্গে যুক্ত থেকে বায়ুশূন্য প্রাণনক্রিয়া করছিলেন। হিরন্ময় অন্ডের গর্ভভূত সেই অনন্ত বিশাল ব্রহ্মান্ডের পূর্বে শয়ন করে তিনি 'পুরুষ' নামে খ্যাত হলেন। সেই হিরণ্যগর্ভভূত অন্তরপুরুষ যিনি সর্বগত, যাঁর দ্বারা সর্বজগৎ ব্যাপ্ত, যিনি সকলের অন্তরে বিরাজ করেন, তিনিই পরমব্রহ্ম পরম-আত্মা। তিনি যখন সর্বজগৎ ব্রহ্মান্ডরূপে ব্যাপ্ত করলেন তখন তিনি বহু হবার কামনা করে প্রকৃষ্টরূপে জাত হলনে। তিনিই জাত হলেন 'প্রজা'রূপে আর তিনিই তার পালয়িতা হলেন বলে তিনি 'প্রজাপতি' রূপেও খ্যাত হলেন। ছিলেন 'দহর' অতি ক্ষুদ্র, হলেন ব্যাপ্ত বহুরূপে; আর সকলের অন্তর পুরুষরূপে সকলপুরে সকলদেহে শায়িত হলেন, অধিষ্ঠিত হলেন, অধিষ্ঠিত হলেন বিন্দুবৎ অতি ক্ষুদ্ররূপে। তিনি যখন ব্যাপ্ত হলেন তখন সেই পুরুষ হলেন সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু, সহস্র চরণ। কিন্তু তিনি সকল কিছু হয়ে ও সব কিছুকে অতিক্রম করে ক্রান্তদর্শীরূপে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে অবস্থান করলেন। নিজের সৃষ্টির চেয়ে তিনি মহৎ হয়ে রইলেন। এই যা হয়েছে আর ভবিষ্যতে যা হবে সকলই সেই পুরুষ। এই বিশ্বজীব তার এক আওংশ মাত্র, যা ভূত ভবিষ্যৎ ও বর্তমান এই তিন কালের সংসারচক্রের মধ্যে অবস্থিত। সেই পুরুষের অপর যে তিন অংশ তা এই তিনকালের অতীতরূপে ঊর্ধ্বে সেই পরমস্থানে অবস্থান করলো যে পরমস্থানের বিষয় মানুষের চিন্তাজগতের অনধিগম্য। সেই পুরুষ যে এক অংশের দ্বারা চেতন ও অচেতন সকল পদার্থকে ব্যাপ্ত করলেন তা থেকে যজ্ঞের সুত্রপাত। যিনি এক অদ্বিতীয়রূপে ছিলেন তিনি বহুরূপে বিচিত্র লীলা করবার ইচ্ছা করলেন। তিনি যাচ্ঞা করলেন; তিনিই পূজা করলেন; তিনিই বহু হয়ে সকলের সঙ্গে মিলিত হলেন; তিনিই নিজেকে নিজে সকল কর্মে দান করলেন, অর্পণ করলেন। আর এ সকলই যজ্ঞকর্ম এবং তিনিই স্বয়ং যজ্ঞ। আর এই যজ্ঞ কর্মে তিনিই প্রথম বলি। তিনি তাবৎ বস্তুকে নিরীক্ষণ করলেন সমান দৃষ্টিতে; তাই তিনি পশু। আর তিনিই প্রথম যজ্ঞীয় পশুরূপে নিজ বহ্নিতে আহুতি দিলেন। সেই অগ্নিই নিজেকে নিজে অগ্নিতে আহিতি দিলেন, বিভিন্ন আকৃতিতে খন্ড খন্ড হলেন, আর সেই আহিতিভারকে স্বয়ং বহন করে চললেন অনন্তকাল ধরে মহাশূন্য মহাকালরূপে। এই কালই অশ্ব যা সকল কিছু বহন করে নিয়ে চলে। এই যজ্ঞীয় অশ্বের শীর্ষে রইলেন ঊষা - প্রথম আলোর চরণধ্বনি। তাঁর পশ্চাতে আগমন করলেন সূর্য চক্ষুরূপে, যিনি সর্বলোককান্ত, যিনি সর্বলোকের দ্রষ্টা। এই মহাভোজী অশ্বরূপী মহাকাল সপ্তরশ্মি, অবিনাশী, অজর, সহস্রচক্ষু, ভূরিরেতা, যা বহু প্রজননের অধিকারী এবং যার গর্ভে জন্মবীজ নিহিত। বহু প্রজননের জন্য এই কালকেই মানুষ পূজা করে। এই কালের চাকা এই বিশ্বভূবন। এই কালচক্রেই আরোহণ করে মানুষের মধ্যে যাঁরা উত্তমদ্রষ্টা সেই ঋষিগণ এই ব্রহ্মকে নিরীক্ষণ করলেন। আর সে পুরুষ যিনি এইভাবে সব হয়েছেন, তিনিও এই সব নিরীক্ষণ করলেন। তিনি এই সব সৃষ্ট জগতের মধ্যে প্রবেশ করতে চাইলেন। আর তার সৃষ্ট জগতে প্রবেশ করতে ইচ্ছা করে তিনি যখন বিশ্বকে নিরীক্ষণ করলেন তখন নিজেই বলে উঠলেন - 'অহো, আমিই আমাকে আমার আত্মস্বরূপে এই স 'ইদম্' রূপে দেখলাম।' সেই 'ইদম্'-ই প্রত্যক্ষভাবে পরমাত্মা। তিনিই 'ইদম্' রূপে দ্রষ্টা হয়ে 'ইদন্দ্র' নামে খ্যাত হলেন। এই 'ইদম্'-ই পরোক্ষভাবে 'ইন্দ্র' নামে অভিহিত।

কিন্তু এই যে দৃশ্যমান বস্তু যা বহুপ্রকারে বহুরূপে জাত, তা কোথা হতে সৃষ্টি হোল? কেই বা তা দেখেছে? কেই বা তা বলে দেবে? যে উপাদান কারণ থেকে এই সর্বজগতের উৎপত্তি তা তো পরে জন্মেছে। যারা পরে জন্মেছে তারা কেমন করে বলবে সৃষ্টির উপাদান কারণ কি? যিনি এই সমস্ত সৃষ্টির কারণ তিনি হয়তো একে ধারণ করে আছেন, হয়তো নেই। যিনি স্বীয় মহিমার সত্যস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এই জগতের অধ্যক্ষরূপে পরম ব্যোমে অবস্থান করছেন তিনিই হয়তো এইসব জানেন, হয়তো জানেন না। তবে কে দেখলো এই সব? কে-ই বলবে সে কথা?

এই প্রশ্ন চিরন্তন। এ প্রশ্ন ঋষির, আর এই প্রশ্নের উত্তর জানবার জন্য মানুষদের মধ্যে যাঁরা শ্রেষ্ট মানুষ তারা, করে কোন্ যুগে কত দীর্ঘ হাজার হাজার বছর আগে, তা কেউ জানে না, কোন কিছু অধ্যয়ন না করে তপস্যায় বসলেন, সৃষ্টিরহস্যের সন্ধানে। এই বেদ বা জ্ঞানলাভের জন্য স্বভাবনির্মল তপস্যানিরত মনুষ্যশ্রেষ্ঠদের সামনে স্ব্যয়ম্ভু স্বয়ং উপস্থিত হলেন। আর তখন তাঁরা ব্রহ্মকে সমগ্র বেদকে সমস্ত জ্ঞানকে স্বরূপে দর্শন করে ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে ব্রাহ্মণরূপে অভিহিত হলেন। যেখানে নয়ন গমন করে না, সেখানে বাক্য গমন করে না, সেখানে মনও গমন করে না, যে ব্রহ্মের স্বরূপ নিজেরই জানা নেই তা অপরের জ্ঞানের বিষয়ীভূত কিভাবে করা যাবে? তাই তপস্যারত পুরুষদের সামনে স্বেচ্ছায় শরীর পরিগ্রহ করে স্বয়ং বেদ যখন উপস্থিত হলেন তখন-ই তা জ্ঞানের গোচর হল। আর এইভাবেই বিনা অধ্যয়নে দর্শনক্রিয়ার দ্বারা সমগ্র বেদরাশি সেই তপস্যানিরত পুরুষদের সামনে স্বয়ং সমাগত হয়েছিলেন বলে সেই ব্রাহ্মণগণ ঋষি হয়েছিলেন। এই ঋষিগণ সেই ধর্মের (=যাঁর দ্বারা সকল কিছু ধৃত) সাক্ষাৎ দ্রষ্টা হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যাঁরা ধর্মকে সাক্ষাৎ করেন নি অথচ সমগ্র বেদরহস্য জানতে ইচ্ছুক ছিলেন সেই পরবর্তীকালের ঋষিদের পূর্ববর্তী সাক্ষাৎধর্মা ঋষিগণ সমগ্র বেদরহস্য মন্ত্রের দ্বারা উপদেশের দ্বারা প্রদান করেছিলেন।

এই যিনি ইন্দ্রিয়জ্ঞানের অগোচর - অদৃশ্য, কর্ম-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যাঁকে গ্রহণ করা যায় না - অগ্রাহ্য, যাঁর মূল জানা নেই - অগোত্র, যিনি সকল বর্ণ ও রূপের কারণ হয়েও নিরাকার - অরূপ, যিনি সর্বদর্শনকারী হয়েও চক্ষুহীন - অচক্ষু, যিনি সর্বশ্রবণ সমর্থ হয়েও কর্ণহীন - অশোত্র, যিনি সর্বকর্মকারী এবং সর্বত্রগমনকারী হয়েও হস্তপদ-বিহীন - অপাণিপাদ, যিনি নিত্য, বিবিধপ্রকারে বর্তমান থেকে বিভু, যিনি সর্বগত, যিনি সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম, যিনি অব্যয় এবং সর্বভুতবর্গের কারণ, তাঁকেই বিবেকীরা 'পরাবিদ্য' রূপে সর্বত্র দর্শন করেন। ইনিই পরাবিদ্যা, ইনিই সর্বজ্ঞ, সর্ববিদ্, ইনি-ই সর্বজ্ঞানময় তপস্যা, ইনি-ই ব্রহ্ম, ইনি-ই রূপ, ইনি-ই অমৃতরূপে বারি, ইনি-ই অন্নরূপে জাত। এই পরাবিদ্যার দ্বারা সেই অক্ষর অনিনাশী ব্রহ্মকে জানা যায়। এই অক্ষর হতেই অন্ন, অন্ন হতে প্রাণ, প্রাণ হতে মন, মন হতে সত্য, সত্য হতে লোকসমূহ, লোকসমূহ হতে অমৃতত্ব জাত হয়ে জাগতিক ক্রম সম্পূর্ণ হয়। সেই প্রজ্বলিত তপস্যা থেকে ঋত জাত হোল, যজ্ঞ জাত হল, দিবা ও রাত্রি জাত হোল, জলপূর্ণ সমুদ্র জাত হোল, সংবৎসর জাত হোল; আর কালের নিয়মনিবদ্ধগতিকে পরিচালনার জন্য নক্ষত্রলোক, সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী ও অন্তরিক্ষ জাত হোল। এই জাগতিক সুনিয়ত কার্যক্রম 'ঋত' শব্দবাচ্য। এই ঋত-ই সত্য, যজ্ঞ, জল ও ধন নাম খ্যাত। আর যিনি ঋতকর্মের ধারক তিনিও ঋতদেবতা; ঋতম্ভর। তিনি অমৃতবারিরূপে; 'ঋতং বৃহৎ'। তিনি হংসের মত শুদ্ধ অমৃতবারিকে আশ্রয় করে সর্বত্রগামী হয়ে দ্যুলোকে আদিত্যরূপে অধিষ্ঠিত। তিনি অন্তরিক্ষে বায়ুরূপে, তিনি পৃথিবীতে পার্থিব অগ্নিরূপে, তিনি অমৃতবারি সোমরূপে, তিনি সকল দেবতারূপে, আকাশরূপে সত্যরূপে, নদী, অন্ন, পর্বত - এই যা কিছু সব হয়েছে। কারণ তিনি যে মহান।

কিন্তু আ তো পরাবিদ্যা, তত্ত্বকথা। যিনি তপস্বী, যিনি তত্ত্বজ্ঞ, যিনি ঋষি তিনি এসব বুঝতে পারেন, দর্শন করতে পারেন এবং তত্ত্বকে জেনে তত্ত্বসন্বন্ধী যথার্থ জীবন যাপন করতে পারেন। কিন্তু যাঁরা কর্মব্যস্ত মানুষ যাঁদের নিত আহার সংগ্রহ করতে হয়, যা%রা সুখে শান্তিতে কালাতিপাত করতে চেন, যারা অন্নের উপায় জানতে চান, যাঁরা নিরোগদেহে নিরুপদ্রবে জীবনযাপন করতে চান, যাঁদের জন্য জীবনসংগ্রাম নিত্য সম্মুখ সমরের মত দুয়ারে দাঁড়ায়ে থাকে, যাঁরা অন্নময় প্রাণময় শরীর রক্ষায় সদা ব্যস্ত, তাঁদের জন্য এ তত্ত্ব কি মুল্য বহন করবে?

এ প্রশ্নের উত্তরও ঋষি দিয়েছেন। ঋষি বলেছেন - ব্রহ্মবিদ্ তো অন্নের নিন্দা করেন না। যাঁর অন্ন নেই তাঁর প্রজ্ঞাও নেই। যাঁর প্রজ্ঞা নেই তাঁর বলও নেই। যাঁর বল নেই তিনি এই আত্মাকে লাভ করতে পারেন না। আর আত্মাকে জানলেই পরাবিদ্যা লাভের পথ প্রশস্ত হয়। অন্নময় প্রাণময় মনোময় বিজ্ঞানময় আনন্দময় পুরুষই তত্ত্বগ্রহণে সমর্থ। আর যথার্থ তত্ত্বজ্ঞান সহায়ে জীবৎকালে মুক্ত অবস্থায় সকল কর্ম করেও অভয় ও সদানন্দ হন।

তবে কি ভাবে সংসারমার্গে বিচরণকারী মানুষ পরমজ্ঞান লাভ করতে পারে? এর উত্তরে বলা হয়েছে যে, মিথ্যাজ্ঞানজনিত যে বাসনা কামনা তা-ই ইহলোকের দুঃখের কারণ। এই মিথ্যাজ্ঞানজন্য যে বাসনা তা থেকে ক্রমমুক্তির উপায় জানতে হবে। আর তা জানবার জন্যই বেদের আলোচনা করতে হবে। পূর্বে বলা হয়েছে - দুটি বিদ্যাই জানবার আছে, একটি পরাবিদ্যা ও অপরটি অপরাবিদ্যা; সেই অপরাবিদ্যা পরাবিদ্যালাভের ইঙ্গিত দেয়। যে বিদ্যার ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে, যা ইহলোকিক সুখের সন্ধান দেয় এবং পারলৌকিক মুক্তির উপায় তা অপরাবিদ্যা। সেই অপরাবিদ্যার মধ্যে ঋগ্বেদ, যজূর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ আলোচনার দ্বারা বিবেকী হওয়া সম্ভব। এই প্রযুক্তি বিদ্যাই দুঃখের পরপারে নিয়ে যেতে পারে; আত্মার সাক্ষাৎকার সহায়ক হতে পারে; দেবতার সঙ্গে সখ্যতা স্থাপনে সহায়ক হতে পারে। বালকেরা যেমন প্রথম বস্তুর নাম শেখে এবং পরে শিক্ষালাভের দ্বারা ক্রমে ক্রমে উৎকৃষ্ট জ্ঞান সঞ্চয় করে ও সেই জ্ঞানকে কর্মের সহায়রূপে নিযুক্ত করে, ঠিক সেইভাবে বেদচর্চার দ্বারা প্রতিটি মানুষ জ্ঞান অর্জন করে ইষ্টবস্তু লাভ করতে পারেন। সকল ব্যক্তিই যেমন চক্ষুকর্ণহস্তপদবিশিষ্ট হলেও সমান যোগ্যতাসম্পন্ন হন না তেমনি যার যেমন সাধনা যার যেমন যোগ্যতা সেই অনুসারে বেদচর্চা করলে ক্রমেই শ্রেয় লাভ করেন।

এখন দেখা যাক, যে ঋগ্বেদ, যজূর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ, যা অপরাবিদ্যা নামে অভিহিত হোল, তার আলোচ্য বিষয় কি? পূর্বে বলা হয়েছে, যিনি জগতের কারণ তিনি প্রথমে সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম রূপে স্বীয় মায়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি পরে তাঁর ইচ্ছামাত্র সেই ঐশী মায়াশক্তির সঙ্গে যুক্ত থেকে এই সব কিছু হলেন। তাঁর সেই অদীনা অক্ষীণা ঐশী মায়াশক্তি অদিতিই সকল কিছুর জন্ম দিয়েছেন বলে এই যা কিছু দৃশ্য পদার্থ তা আদিত্য নামে অভিহিত। তার মধ্যে আমাদের জীবকূলের প্রয়োজনে সূর্যরূপে যিনি জাত হলেন, তিনি জগতের চক্ষু, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বলে 'আদিত্য' নামে পরিচিত হলেন। এই সূর্যমন্ডলের অধীনে তিনলোক। সূর্য যেখানে যে পরমস্থানে (আধুনিক বিচারে নয় কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল দূরে) বাস করেন, সেই স্থান দ্যুলোক। এই পৃথিবী যেখানে আমাদের বাসনা-কামনা সুখ-সম্পদ দুঃখ-ব্যাধি ভয়-নিরাপত্তা প্রভৃতি বর্তমান তা ভূলোক। দ্যুলোক ও ভূলোকের মধ্যবর্তী যে আকাশ তা তা অন্তরিক্ষলোক, স্বপ্নময়লোক। এই দ্যুলোক, ভূলোক ও অন্তরিক্ষলোক এবং এরই মধ্যবর্ত্তী আর যা কিছু সব সুর্যমন্ডলের অন্তর্গত। যিনি অগ্নিরূপে যাত্রা করেছিলেন সৃষ্টির প্রারম্ভে তিনিই দ্যুলোকে সূর্যরূপী অগ্নি, অন্তরিদখে বিদ্যুৎরূপী অগ্নি এবং পৃথিবীলোকে পার্থিব অগ্নিরূপে অধিষ্ঠিত হলেন। আর সূর্যমন্ডলের বাইরে সেই প্রম অগ্নি অসংখ্য নক্ষত্ররূপী জাত হলেন।

এই যে সূর্য ইনি প্রত্যক্ষ দেবতা। ইনিই আত্মা। আত্মার সাক্ষাৎকারের জন্য অনেকে অনেক উপায়ের সন্ধান দেন কিন্তু যিনি সূর্যতে আত্মার অধিষ্ঠানের বিষয় জানেন তিনি সহজেই আত্মার সাক্ষাৎকার করেন। প্রকৃতপক্ষে আত্মা আমাদের থেকে কখনও দূরে নেই। তিনি মানুষের মধ্যে অহং বা 'আমি' রূপে পরিচিত। আর তিনিই আত্মজন্মা ও স্বেচ্ছাজন্ম হয়ে স্বকার্যসাধনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে সূর্যে অধিষ্ঠিত আছেন। যা দীপ্তি দেয় তাই 'দেব'। ঐশ্বর্যদান করেন বলে তিনি 'দেব'। তেজঃস্বরূপ বলে সকল পদার্থকে প্রকাশ করেন, তাই তিনি 'দেব'; আর দ্যুলোকে অবস্থিত বলে তিনি 'দেব'। যিনি দেব তিনিই দেবতা। আর সেই পরম অগ্নি যিনি সকল অগ্নিরূপে বিশ্বের সকল ভবনে সকলস্থানে অগ্নি নামেই খ্যাত হয়ে আছেন সেই অগ্নিই সকল দেবতা। এই পৃথিবীতে যিনি অগ্নিরূপে পরিচিত তিনিও সেই অগ্নি। বিশেষ কর্মে বিশেষ অধিকারের জন্য সেই আত্মারূপী একই অগ্নি বিভিন্ন নামে পরিচিত। তিনি ইন্দ্র-মিত্র বরুণ সুপর্ণ গরুতান্ মাতরিশ্বা যম অজ একপাৎ, ত্বষ্টা, বিশ্বানর, বৃষাকপি, আদিত্য, বিষ্ণু, পূষা, ভগ, রুদ্র, সবিতা কেশী প্রভৃতি নানা নামে বহুরূপে বর্ণিত হন। আর এই যে আদিত্য সূর্য এঁর রশ্মিসকলও দেবতা। এই কিরণরাশিই 'দেবগণ' বা 'বিশ্বদেবগণ' নামে পরিচিত। এই 'বিশ্বদেবগণ' কোন বিশেষ শ্রেণীর দেবগণ নন, এঁরা সকল দেবতার বোধক। তবে একথা সকলে স্বীকার করেন না। বিরুক্তকার শাকপূণি বলেন, বিশ্বদেবগণ বিশেষ ধরণের একশ্রেণীর দেবতা, যাঁরা বিশেষ কার্য সম্পন্ন করেন। এঁরা সংখ্যায় তেত্রিশ - দ্যুলোকে এগার, পৃথিবীতে এগার, এবং অন্তরিক্ষেও এগার। ব্রাহ্মণগ্রন্থে বলা হয়েছে, অষ্টবসু, দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র, প্রজাপতি ও বষট্ কার - এই তেত্রিশ বিশ্বদেবগণ। এই বিশ্বদেবগণ নিজ মহিমায় সমস্ত যজ্ঞকর্মকে মিলিত করেন। মনে রাখতে হবে সকল সুকর্মই যা সকলের সঙ্গে মিলিত হয়, পূজিত হয়, পার্থিত হয় তা যজ্ঞকর্ম। সূর্য মন্ডলের অধীনে গণদেবতাদের মধ্যে বসুগণ, রুদ্রগণ, আদিত্যগণ, মরুৎগণ, সপ্তঋষিগণ, সাধ্যদেবগণ, বাজিগণ, বিশ্বদেবগণ, ঋভুগণ, আঙ্গিরোগণ, পিতৃগণ, অথর্বগণ, ভৃণ্ডগণ, আপ্তাগণ, দেবপত্নীগণ প্রধান। এই গণদেবতারা কর্মবিভাগ অনুসারে পৃথক পৃথক। বলা বাহুল্য, এঁরা সকলেই সূর্যের রশ্মির বিভিন্ন কার্যসাধনরূপ; যেমন মরুৎগণ প্রাণবায়ু, আদিত্যগণ সূর্যের দ্বাদশমাসের দ্বাদশরূপ, রুদ্রগণ রোগ উৎপন্ন করে বিনাশসাধন করেন, সাধ্যগণ বৃষ্টিদানরূপ অসাধ্য সাধন করেন, দেবপত্নীগণ জলের পালিকা শক্তি, বাজিগণ যজ্ঞকর্মকে ব্যাপ্ত করেন, ভৃণ্ডগণ বাষ্পীভূত বারিরাশিকে শুষ্ক করেন, বসুগণ সর্বলোকে ব্যাপ্ত ধনদানকারী রশ্মি, পিতৃগণ সূর্যের দক্ষিণায়ন-কালীন বর্ষণকারী রশ্মি, অথর্বগণ অগতিস্বভাব স্থিররশ্মি ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, বিরুক্তকারগণ বলেন, সকল রশ্মিই সমান দীর্ঘ নয় বা বিস্তৃত নয় এবং সকলের কর্মসম্পাদ ক্ষমতাও সমান নয়, রশ্মিগনের মধ্যে পাঁচটি অশ্বরশ্মিই দীর্ঘাকার। বৃষ্টিপ্রধান, জলরস আহরণ প্রভৃতি কর্মে নিযুক্ত রশ্মিগণকে যে শক্তি পালন করে থাকেন তাঁরা দেবপত্নী নামে বা দেবী নামে অভিহিতা। এই দেবী শক্তি সেই ঐশী অদীনা অক্ষয়া মায়াশক্তি প্রজ্ঞা যিনি আত্মার সঙ্গে অবিভাগাপন্না, তাঁরই বিস্তার। এঁদের মধ্যে সরস্বতী, সূর্যা অগ্নায়ী, ইন্দ্রাণী, অশ্বিনীরাট্, রোদসী, বরুণানী প্রধানা। প্রতি ঋতুতে কালে কালে যে যজ্ঞকর্ম সাধিত হয় তাই ঋতুপথ সত্যপথ। এই ঋতকর্মের প্রজ্ঞাকর্মের পালিকা শক্তি দেবপত্নীগণ। আর অগ্নিই সেই ঋতুপথে সত্য পথে সকল্কে নিয়ে চলেন। সকল যজ্ঞকর্মই অগ্নি করেন, মানুষেরা সেই যজ্ঞের অনুকরণ করেন মিত্র। যজ্ঞের সামান্য অংশই যাজ্ঞিক মানুশ সমাধান করতে পারেন। তবে যিনি অগ্নির ঋতকর্মের সত্যকর্মের সঙ্গে ভাবনার দ্বারা মননের দ্বারা একাত্ম হয়ে যান তাঁকে অগ্নি সঠিক পথে নিয়ে যান। তখন অগ্নির সঙ্গে সাধকের সখ্যতা হয়। এই যে অগ্নির স্বরূপ রশ্মিগণ যাঁরা নিত্য আমাদের ঘিরে আছেন, তারা শ্রবণসমর্থ, কর্মসমর্থ, প্রজ্ঞাযুক্ত নিরাকার চৈতন্য। এঁরাই অগ্নির দূতস্বরূপ, এঁরাই জানতে পারেন আমাদের মনোবাসনা কামনা। যা সত্য, যা ঋত, যা উন্নত, তা সকলই এঁদের অধীন। রশ্মির সঙ্গে সখ্যতাই দেবগণের সঙ্গে সখ্যতা তথা আত্মার সঙ্গে সখ্যতা। এই সখ্যতার দ্বারাই সর্বসিদ্ধি লাভ হয় আর এই দেবরশ্মিগণই আমাদের কুকর্ম থেকে নিবৃত্ত করে সত্যপথে নিয়ে চলেন। এঁরা এই কর্মে অতন্দ্র, অনলস। যদিও আমরা ভুল করি তথাপি এঁরা আমাদের সঠিক পথে নিয়ে যাবার জন্যই অপেক্ষা করেন। যখন কুকর্ম আর পাপ আমাদের মধ্যে প্রবল হয় ওঠে তখন এঁরা সেই পাপকে ধ্বংস করতে গিয়ে হয়তো আমাদেরও ধ্বংস করেন কিন্তু তার সকল কিছুতে জ্যোতিতে পরিণত করেন, কারণ জ্যোতিই সত্য ও পরম। এই ধ্বংসকর্ম যখন তাঁরা করেন, তখন পাপরূপ শত্রুকে দুঃখসন্তপ্ত করেন তখন তাঁরা রুদ্ররূপেই এই কর্ম করেন এবং কর্ম করার সময় নিজেরাও রোদন করেন; কারণ অগ্নির সকল কর্মই যে অহিংসিত কর্ম, তাঁর সকল যজ্ঞই অহিংসা। তিনি ভয়ঙ্কর হলেও করুণাসিন্ধু।  এই তাঁর প্রকৃত রূপ।

এই যে পরমাত্মা অগ্নি যিনি এক হয়েও প্রভূত ঐশ্বর্যবলে বহুনামে বহুরূপে স্তুত সেই পরমাত্মারই অঙ্গস্বরূপ অন্য দেবগণ। দেবতারা পরস্পর ভিন্ন এবং তাঁদের স্তুতিও পৃথক কারণ তাঁদের নাম ভিন্ন, কার্যও ভিন্ন। একই ব্যক্তি যেমন কখনও পিতা কখনও স্বামী কখনও বন্ধু, দেবতাদের কার্যও সেরূপ। দেবতাদের সংখ্যা বহু হলেও তাঁরা পৃথিবী, অন্তরিক্ষ ও দ্যুলোক - এই তিন স্থান ব্যাপ্ত করে বর্তমান আছেন। প্রকৃতপক্ষে অগ্নিই পরমাত্মা, বহুরূপে শ্রুত এবং সর্বদেবতা, যিনি ত্রিলোকব্যাপী। এই পৃথিবীর মানুষ, পশু, পক্ষী এবং আর সকল জীব ও অজীব যেমন পৃথিবীতে বাসকারী বলে 'পার্থিব' নামে পরিগণিত হতে পারে তেমনি দেবগণও তিনলোকের সম্যক্ পালনের দ্বারা 'এক' বলে পরিগণিত হতে পারেন। লৌকিক দৃষ্টান্তে এই ভেদাভেদ নর এবং রাষ্ট্রের মত।

সুতরাং কার্যসাধনের জন্য সেই এক পরম অগ্নি সূর্যরূপে জাত হলেন আর সূর্য হলেন তাঁর স্বীয় মণ্ডলের সম্রাট। তাঁর সাম্রাজ্যকে তিন প্রধান ভাগে ভাগ করে পরমাত্মা অগ্নির উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তিনি নিরন্তর বাধ্যতামূলক কর্মে নিজে প্রবৃত্ত থেকে স্বীয় সাম্রাজ্যের সকলকেও সেই কর্মে নিযুক্ত করলেন। দ্যুলোকে তিনি রইলেন সূর্যরূপে; আকাশ ছাড়া কোন বলকার্য সম্ভব নয়। তাই কাকাশকে সকল বলকার্য সাধনের জন্য নিযুক্ত রেখে সেই আকাশে বজ্র বিদ্যুৎ বায়ু প্রভৃতিকে ইন্দ্র নামে পরিচিত করলেন। এই যা কিছু বলকার্য অন্তরিক্ষে, এবং এই পৃথিবীতে দেখা যায় তা সর্বই ইন্দ্রকর্ম। এমন কি অতি ক্ষুদ্র প্রাণীর কর্ম ও বলকর্ম বা ইন্দ্রকর্ম। আর সেই পরম অগ্নি এই পৃথিবীতে অগ্নিরূপে নিজেকে নিযুক্ত করলেন সর্বকর্মারূপে, বিশ্বের সকল অগ্নির সঙ্গে সন্বন্ধ রাখার জন্য। ঐ দূরে বহুদূরে দূরতম প্রদেশে, চিন্তার অনধিগম্য প্রদেশে যিনি অগ্নিরূপে বর্তমান, তিনিই এই পৃথিবীতেও অগ্নিরূপে বর্তমান। তিনি সেখানেও যা, এখানেও তা। সেই অগ্নিই এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য সূর্যের মধ্যে অবস্থান করলেন আত্মারূপে। জগতের আত্মা সূর্য তখন তাঁর রশ্মিদের সপ্তচ্ছন্দে ছন্দায়িত করে সপ্ত বায়ুস্তর ভেদ করে মানুষকে বিস্তীর্ণ সুজন্মা ভূমি প্রদানের ইচ্ছা করে পৃথিবী পরিক্রম করলেন। আমাদের উদার আশ্রয় দেবেন বলে রশ্মিগণকে নম্রভাবাপন্ন করে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন; তা না হলে তার রশ্মির প্রখর তাপে পৃথিবী যে ঊষর ভূমিতে পরিণত হবে। তাই তিনি সৃষ্টির কারণে, আনন্দের কারণে পৃথিবীতে সূর্যরশ্মির দ্বারা বিনীতভাবে প্রবেশ করলেন। যাঁর পদ অন্তরিক্ষ পরমস্থানে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, যিনি ছলরহিত, যিনি কাউকে হিংসা করেন না, যিনি চরাচর বিশ্বের রক্ষক সেই বিষ্ণু সূর্য তিনপাদের দ্বারা অর্থাৎ উত্তরায়ণ, দক্ষিণায়ন ও বিষুববিন্দু স্পর্শের দ্বারা বিশ্বভূবন পরিক্রমা করেন। আর এই ভাবে জগৎ পরিক্রমা করে তিনি সকল ধর্ম, সকল ব্রত, সকল কর্মকেই ধারণ করে থাকেন। আদিত্যের কর্ম দ্বাদশ প্রকার। তিনি উদয় ও অস্ত গমনের দ্বারা দিন ও রাত সৃষ্টি করে বার মাস, ছয় ঋতু ও সংবৎসর রচনা করেন। আদিত্যের কর্ম রশ্মিসহায়ে জলরস আকর্ষণ, রশ্মির দ্বারা রসধারন, আর যা কিছু প্রচ্ছাদন প্রকাশন তা সমস্তই আদিত্যের কর্ম।  আদিত্যের উদয়ে ভারত্রি ও গ্রহ নক্ষত্রের প্রচ্ছাদন বা অন্তর্ধান হয়; অবিদ্যা দূর করে আদিত্য জ্ঞানের প্রকাশ সাধন করেন। এই যে আদিত্য ইনি কখনও অস্তমিত হন না, উদিতও হন না। ইনি সর্বদা একরূপ। তাঁকে যখন অস্তমিত মনে করা হয় তখন তিনি সেই দেশে দিনের সমাপ্তি করে রাত্রি করেন ও অন্য দেশে দিন করেন। আবার সখন তাঁকে প্রাতঃকালে উদিত মনে করা হয় তখন তিনি সেই দেশে দিন করেন ও অন্য দেশে রাত্রি করেন। এই ঊষা ও রাত্রি যেন দুই ভগিনী। সন্ধ্যার আগমনে অরুণ যখন ধূসরবর্ণ প্রাপ্ত হন তখনই রাত্রির আরম্ভ। এই ধূসরবর্ণা রাত্রি শ্যাবী নাম ধারণ করেন। ক্রমে রাত্রির রূপ পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রথম রাত্রিকাল পর্যন্ত তিনি দোষারূপিণী, মধ্যরাত্রিতে তমস্বতী; আর নক্তারূপে রাত্রি অব্যক্তবর্ণা। তখন তিনি ব্যক্তবর্ণ দিনের বিপরীতরূপ এবং হিমবিন্দুর দ্বারা জগৎ সিক্ত করেন। তিনি ঊধঃরূপে স্নেহরস প্রদান করেন, বস্বীরূপে ভগিনী ঊষার আগমনের পথ করে দেন। জ্যোতিঃসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এই ঊষা তখন বিচিত্র প্রকাশভঙ্গীতে অতি বিস্তারের সঙ্গে জন্মলাভ করেন। এই নক্ষত্রখচিত রাত্রিদেবী যেন ময়ূরপুচ্ছধারিণী, নিদ্রারূপ মায়াজাল বিস্তারে পাশহস্তা। রাত্রির আগমনে জনপদসমূহ নিস্তব্ধ, বিহঙ্গরা নীড়াশ্রয়ে সুখে বাস করে, পথচারী ও শ্যেন সকলেই শয়ন করে। রাত্রির অন্ধকার যেন ঋণের মত সর্বদা আচ্ছন্ন করে রাখে। ঊষার আগমনে ঋণের মত কৃষ্ণা রাত্রি দূরে চলে যান। রাত্রির শেষরূপ 'বস্বী' যখন ধনভারে অবনতা হয়ে ঊষার আগমনের পথ করে দিয়ে অন্তর্হিতা হন তখন ধনবতী ঊষা বিচিত্র ভঙ্গীতে তাঁর জ্যোতিকে অতি বিস্তীর্ণ করেন। ঊষা দেবী ভগিনী রাত্রিকে জ্যোতির দ্বারা অপাবৃত করে তমস্যার পারে দাঁড়িয়ে নিজে নিজেই হাসতে থাকেন। নিয়ত রূপ-পরিবর্তনকারিণী ঊষা ও রাত্রি কখনও স্থির হয়ে অবস্থান করেন না। সকল বস্তুর উৎপাদনকারিণী রাত্রি ও ঊষা ভিন্নরূপা হলেও সমানমনা; একে অপরকে বাধা দেন না। একে অন্যের বর্ণ বিনাশ করেন না, একে অন্যের পরে আগমণ করেন। পার্থিব ধনের ঈশ্বরী ঊষা কাউকে ধনের জন্য, কাউকে অন্নের জন্য, কাউকে যজ্ঞের জন্য, কাউকে বা অভীষ্টলাভের জন্য জাগরিত করেন। ভুবনপ্রকাশিকা ঊষা সকলের জীবনের উপায়। এই অহোরাত্রই জ্যোতি দ্বারা দিনকে এবং হিমের দ্বারা রাত্রিকে পরিব্যাপ্ত করেন। এই অহোরাত্রই দেশ ও কালে পরিব্যাপ্ত। এই কাল গতিযুক্ত, নমনীয়, দর্শনীয়, ধ্বংসকারী ও শব্দকারী। কাল-ই শস্য উৎপন্ন করে ও ভোজন করে; কাল-ই অতি প্রসারিত ক্ষিপ্রহস্তযুক্ত; কাল-ই কল্যাণকারী, বহুভোজী। এই বুদ্ধি নিহিত; কাল-ই বহুকর্মকারী, অপ্রতিহতগতি, শত্রুক্ষয়কারী, রোগনাশকারী, মিথ্যারহিত, শত্রুরোদনকারক, আবার কালই স্বয়ং রোদনকারী। এই কালের গতিচক্র সদা সচল থাকে বৃষ্টি সম্পাদনের দ্বারা, অমৃতবারি বর্ষণের দ্বারা, যা একধনা, যা পেলে মানুষ বাঁচে, শস্য উৎপন্ন হয়, সংসার চক্র নিজ নিয়মে চলতে থাকে। এই বৃষ্টিসম্পাদন, মেঘবিদারণ ও যা কিছু বলকার্য তা সমস্তই ইন্দ্রকর্ম। এমন কি কীটপতঙ্গাদির দ্বারা যে বলকর্ম সাধিত হয় তা সমস্তই ইন্দ্রকর্ম, কারণ বলই প্রাণ, প্রাণই বায়ু, বায়ুই ইন্দ্র। আদিত্য যে রসধারা আকর্ষণ করেন, সেই অমৃতবারিকে ইন্দ্র লোকপালনের জন্য বৃষ্টিধারারূপে বর্ষণ করেন। এই আদিত্য বিষ্ণু সত্যধর্ম ধারণ করতে করতে কর্মসমূহ সৃষ্টি করেন, যে কর্মসমূহের দ্বারা সঙ্কল্প ইচ্ছাশক্তি আজ্ঞা শাসন মর্যাদা নিয়ম বশ্যতা সেবাবৃত্ত ও অধিকার ঐশ্বর্য ও আধিপত্যরূপ ব্রতধর্ম কর্ম সকল রচিত হয়। তাঁর এই ব্রতকর্ম হতে মানুষেরা জীবনধারণপ্রণালী, আচার, ব্যবহার, ধর্মীয় শাসনের প্রতি প্রষস্ত অনুরাগ, তপস্যাজনিত কৃচ্ছ্রতা, পবিত্র ব্রতবদ্ধ জীবনের অভ্যাস করে তাঁর কাছ থেকে মানুষ অনলস অতন্দ্র কর্ম শেখে যে কর্ম জীবের সকল কামনা পূরণ করে। যে আদিত্যরূপী বিষ্ণু দ্যুলোকে দূরতম প্রদেশে অতি উত্তম স্থানে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থেকে সকল কর্ম ধারণ করে জগৎ পালন করেন, তাঁকে ঘিরেই রয়েছে বিশ্বের সকল জ্ঞান। এই জ্ঞান গুণগত বিচারে ঋক্, সাম, যজু, ও অথর্ববেদ এই চার ভাগে বিভক্ত। এই জ্ঞানসমূহ আদিত্যদেবের কিরণরাশিকে আশ্রয় করে রেয়েছে; এরা যেন কিরণরাশির মধুনাড়ীসমূহের মধুকরবৃন্দ। এই কিরণরাশি নিখিল জ্ঞনকে আশ্রয় করে লোহিত, শূভ্র, কৃষ্ণ ও অতিকৃষ্ণচ্ছটা ধারণ করে যথাক্রমে ঋক্, যজু, সাম ও অথর্ববেদ নামে অভিহিত হয়। পূর্বে যে তিন লোকের কথা বলা হয়েছে সেই তিন লোক - অ, উ, ম, এই তিন অক্ষরাত্মক নামেও পরিচিত। অ = পৃথিবী। উ = অন্তরিক্ষ। ম = দ্যুলোক। অ + উ + ম = ওম্। ওম্ শব্দের দ্বারা পূর্ণ ব্রহ্মকেই বোঝান হয়েছে; এই তিন লোকের অতিরিক্ত যে জগৎ যা মানুষের বাক্য ও মনের অগোচর তাও ওঙ্কার; এবং যেহেতু সূর্যের মধ্যে পরমাত্মার প্রকাশ সেহেতু ওম্ শব্দে ত্রিলোকব্যাপী জগতের আত্মা সূর্যের অধিষ্ঠানকেও বোঝায়। এই আদিত্য সূর্য নীলাতিগ কৃষ্ণচ্ছটা থেকে দীপ্তিলাভ করে 'ওম্' উচ্চারণের দ্বারা আকাশ পথে বিচরণ করেন। আর তিনি এইভাবে ঋতের ছন্দে বলতে বলতে উদক, ধন ও সত্য সৃষ্টি করেন; আর সকল কর্মকে স্পর্শ করে আতিক্রান্ত হন। তাঁর এই সকল কর্মঈ ঋত এবং তিনিই ঋতদেব। এই প্রত্যক্ষ দেবতা সূর্য নর বা পুরুষাকৃতি নন বলে অপুরুষব্ধি। ইনি হস্তপদবিহীন, ইনি চলেন, অথচ চলেন না; আর এঁকে ঘিরেই নিখিল বেদ বা জ্ঞান বর্তমান। ইনি নিত্য, কতকাল ধরে উদিত হচ্ছেন, কতকাল ধরে উদিত হবেন তা কেউ জানে না। নিত্য বলেই ইনি যুগে যুগে কবি জ্ঞানী ঋষিদের আলোচনার বিষয়। সূর্য বলে বেদও নিত্য ও অপৌরুষেয় কারণ অপুরুষবিধ সূর্যকেই আশ্রয় করে রয়েছে ঋক্, যজু, সাম ও অথর্ববেদের সকল জ্ঞান। বেদে যত কিছু ভাবনা রয়েছে তা সকলেই বীজাকারে। বেদতত্ত্ব বোঝবার জন্য ষড়বেদাঙ্গ - শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ। তার বেদতত্ত্বকে বিস্তৃত আকারে কাব্যরয়াশ্রিত সাহিত্যের মাধ্যমে যুগে যুগে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য লেখা হয়েছে পুরাণগুলি। সূর্য নিত্যবলে যেমন সকল কালেই সূর্যসংক্রান্ত আলোচনা হয়ে থাকে এবং আজও হয়, তেমনি বেদ সূর্য আশ্রিত বলে সকল কালেই বেদের তত্ত্ব নিরুপণ হয়ে থাকে তেবং আজও হয়।

এই আদিত্য সূর্যের পরমপদে যে মধুর উৎস সেই মধুই ধর্ম। এই ধর্ম বায়ুতে, নদীতে, ওষধিতে, দিবারাত্রিতে, পৃথিবীর ধূলায়, দ্যুলোকে, বনস্পতিতে, কিরণরাশিতে সর্বত্র মধুর মধুররূপে প্রবাহিত হয়ে সকল কিছুই মধুময় করে তোলে। এই ধর্ম সর্বভূতের মধু, সর্বভূত এই ধর্মের মধু। যিনি এই ধর্মে তেজোময় অমৃতময় পুরুষ তিনিই এই আত্মা এই অমৃত এই ব্রহ্ম এই সব। বিজ্ঞান যাঁর সারথি, মন যার সুনিয়ন্ত্রিত, তিনি যে পথের পারের সন্ধান পান তাই আদিত্য বিষ্ণুর পরম পদ। সমস্ত জীবের প্রতি দয়া ক্ষমা শান্তি অহিংসা সত্য ঋজুতা অদ্রোহ অনভিমান লজ্জা তিতিক্ষা ও শম - এই সকলই পরম ব্রহ্মকে লাভের পন্থা। আর সূর্যরূপী জগতের আত্মার প্রতি মনোনিবেশ করে বিদ্বান ব্যক্তি কর্মকে নিশ্চিতরূপে জেনে সেই পরম তত্ত্বকে সম্যক্ দীপ্তি করেন।

পুর্বে যে কথা বলা হয়েছে, ত্রিমাত্রাত্মক 'ওম্' এই অক্ষররূপ প্রতীকের দ্বারা সুর্যমন্ডস্থ পরম্পরুষকে বোঝাচ্ছে, সেই ওঙ্কার অবলম্বনেই বেদবিদ্যাবিহিত কর্ম করে হয়, ওম্ উচ্চারণ করে দেবতাদের শ্রবণ করে হয়, ওম্ উচ্চারণ করে স্তোত্রপাঠ ও সাম গান করা হয়। ওম্ এই অক্ষরের পূজার জন্য সাধকের জীবনের সঙ্গে মনমের দ্বারা এই অক্ষর ব্রহ্মকে মিলিত করার জন্য ওম্ এই অক্ষরের নিজ মহিমার দ্বারা এবং এই ওম্ অক্ষরের পরিণামভূত অন্ন-জল প্রভৃতির রস হতে নিষ্পন্ন হবির দ্বারা এই ওম্ অক্ষরের উদ্দেশ্যই পূজা করা হয়। যিনি অঙ্কারূপ অক্ষরকে এইভাবে জানেন এবং যিনি তা' জানেন না, তাঁরা উভয়েই এই অক্ষরব্রহ্মে অবস্থিত থেকে সকল কর্ম করে থাকেন বটে, কিন্তু যিনি ওঙ্কাররূপে অক্ষর বিজ্ঞান জানেন ও শ্রদ্ধাসহকারে উপাসনাতি করেন তিনি অধিক ফললাভ করেন। যিনি অক্ষর ব্রহ্মকে লাভ করতে চান তিনি 'ওম্' উচ্চারণের দ্বারাই লাভ করেন। কারণ ওঙ্কারই ধনু, জীবাত্মা শর, এবং ব্রহ্ম সেই শরের লক্ষ্য। সাধক প্রমাদহীন হয়ে লক্ষ্য ভেদ করে লক্ষ্যের সঙ্গে অভিন্ন হন। অজ্ঞানরূপ অন্ধকারের অতীত পরপারে যাবার জন্য ওঙ্কার-ই অবলম্বন।

যা শব্দ করে তা স্বর; আর সূর্য 'ওম্' শব্দ করে ভ্রমণ করেন বলে সূর্য-ই 'স্বর'। সুতরাং এই 'ওম্' অক্ষরও 'স্বর', এবং এই ওঙ্কার-ই অমর ও অভয়। এই ওঙ্কার প্রবেশ করে দেবরশ্মিগণও অমর হন।

পূর্বে যে বলা হয়েছে, ওম্ উচ্চারণ করে সামগান করে হয়, সেই সামগান সূর্যকে ঘিরে হয়। সা = প্রকৃতি বা অদীনা অক্ষয়া ঐশীশক্তি; অম্ = আত্মা, যা সূর্য-মণ্ডলের মধ্যে আসীন। সুতরাং সূর্যরূপ জগতের আত্মার সঙ্গে যা ওতপ্রোত তা 'সাম'। আর যেহেতু ঋক্মন্ত্রের দ্বারা সামগান করা হয় সেহেতু ঋক্-ই সাম, এবং সাম-ই সূর্য। আর, যেহেতু সূর্যই সাম ও অঙ্কার, এবং সূর্যই প্রাণরূপে প্রতিষ্ঠিত সুতরাং প্রাণও 'ওম্' উচ্চারণ করে এই জীবদেহেই বিভরণ করে। আর যেহেতু পৃথিবী, দ্যুলোক ও অন্তরিক্ষলোক পরস্পর সন্বন্ধযুক্ত ও একাত্ম, সুতরাং অঙ্কাররূপ সামসঙ্গীত যা সূর্যইসঙ্গীত তা সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত। চরাচর ভূতবর্গ ঊর্ধ্বে অবস্থিত আদিত্য সূর্যেরই স্তব করে থাকেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সামের আশ্রয় 'স্বর'; স্বরের আশ্রয় 'প্রাণ'; প্রাণের আশ্রয় 'অন্ন'; অন্নের আশ্রয় 'জল'; জলের আশ্রয় পুনরায় 'স্বর' বা আদিত্য সূর্য, যাঁকে ঘিরে জল সদা বর্তমান। সুতরাং স্বর বা স্বরলোকের অথবা স্বর্গলোকের অতীত আশ্রয়ান্তের আমাদের কেউ নিয়ে যেতে পারে না। যে সূর্যকে ঘিরে জল সদা বর্তমান সেই জলরাশি অন্তরিক্ষে বিচরণ করে, মেঘগর্জন করে জল দান করে, যা হতে সর্বভূত জাত হয়। অন্তরিক্ষে অবস্থিত এই মেঘগর্জনই বাক্ বা বাক্যরূপে অধিষ্ঠিত, যা বৃষ্টি জল সৃষ্টি করে শব্দ করে। এক বাক্ হতে মেঘ বারিবর্ষণ করে, বাক্ হতে চতুর্দিকে আশ্রিত সর্ববস্তু জাত হয়, বাক্ বা শব্দ হতে অক্ষর সৃষ্টি হয়, এবং এই বাক্-ই বিশ্বের উপজীব্য। এই বাক্ই বিশ্বরূপ সকল উয়ব উচ্চারণ করে; এবং বেদবাক্য ও অন্যান্য লৌকিক বাক্য সকলই এই অন্তরিকশে অবস্থিত মেঘগর্জনরূপ শব্দেরই বাক্ রূপে বিস্তার। তাহলে আকাশরূপ ব্রহ্মই বাক্যের পরমস্থান। আর সমস্ত দেবরশ্মিগণই আকাশব্রহ্মে অবস্থিত বাক্যের বা শব্দের মধ্যে প্রবেশ করে আছেন। এই বাক্-ই অক্ষর বা অবিনাশী, আর তিরলোকাত্মক 'ওম্' এই অক্ষরও অবিনাশী। অতএব 'ওম্' এই অক্ষরই - এই সমস্ত। ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান - এই সকলি ওঙ্কার, এবং অপর যা কিছু ত্রিকালের অতীত তাহাও ওঙ্কার। এই সমস্তই ব্রহ্ম। যিনি সাধক তিনি যদি এই সমস্ত জেনে তিনলোকের ভাবনাকে একত্রে সম্মিলিত করেন তবে ওঙ্কাররূপে প্রতীক অবলম্বনের দ্বারা যা শান্ত, অজর, অমৃত, অভয় ও সর্বোত্তম তা প্রাপ্ত হন। সর্প যেমন জীর্ণ ত্বক-মুক্ত হয়, সাধকও তেমনি ত্রিমাত্রাত্মক ওঙ্কাররূপ সামের দ্বারা ঊর্ধ্বে হিরণ্যলোকে নীত হয়ে সূর্যের মধ্যে পরমপুরুষকে দর্শন করে।

যে আদিত্য সূর্য ব্যাপ্ত হয়ে বিষ্ণুরূপ ধারণ করে কিরণরাশির দ্বারা জগৎ উদভাষিত করেন, যিনি জ্ঞানরাশিকে ধারণ করেন, যিনি জ্ঞানপ্রকাশক বাক্যকে ধারণ করেন, সেই বিষ্ণুর ব্যাপকত্বই সর্বযজ্ঞস্বরূপত্ব। তাই ঋষি বলিয়াছেন, দেবকাম মানুষেরা যে পথ ধরে গমন করে আহ্লাদিত হন, আমিও যেন সেই পথ পাই। এই বিপুলগমণ বিষ্ণু আদিত্যের পরমপদে মধুর উৎসব। তিনিই আমাদের প্রকৃত বন্ধু।

আমাদের এই প্রকৃত বন্ধু সূর্য যেমন অন্ন-জল-আশ্রয় প্রভৃতির দাতা, তেমনি তিনি আমাদের অন্তরে আহ্লাদকর রসসৃষ্টির জন্য চন্দ্রকে ধারণ করেন। এই চন্দ্র যিনি আহ্লাদকর ভসের উৎস তিনি সোম নামেও অভিহিত। জলরূপ সোম যেমন প্রাণিমাত্রেরই আহ্লাদের কারণ, এই চন্দ্র সোমও তেমনি সকল প্রাণীর আহ্লাদের কারণ। এই সোমচন্দ্রের জন্য বিষ্ণু সূর্য মেঘের আগরণ উন্মোচন করে পৃথিবীতে চন্দ্রের স্নিগ্ধ কিরণরাশির প্রবেশের দাওর খুলে দেন। আর সকিল দেবরশ্মি সোমচন্দ্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দলোকের ঐশ্বরিক আহ্লাদ বর্ধিত করেন। সূর্যের যে শোভন রশ্মি গোবৎ স্নিগ্ধ তা চন্দ্রে নমিত হয়ে চন্দ্রকে উজ্জ্বল করে। সূর্যের গো-রশ্মিকে ধারণ করেন বলে চন্দ্র 'গন্ধর্ব' নামেও পরিচিত। শরৎকালীন আকাশে চন্দ্রমার স্বিগ্ধ জ্যোৎস্নার স্পর্শে ঊর্ধ্বাকাশে শুভ্র ঘৃতবৎ মেধের নিরন্তর আনাগোনা যে স্বর্গীয় শোভা সৃষ্টি করে সেই ঐশ্বরিক আহ্লাদ আস্বাদন করেন কবি ও জ্ঞানী বিপ্রগণ। মানুষের মধ্যে যিনি সর্বধন ও সর্বভোগসম্পন্ন, যিনি অন্যের অধিপতি, সেই মানুষ মনুষ্যাসমাজে মনুষ্যনন্দের পরমানন্দের নিদর্শন। আর এই গন্ধর্ব বা চন্দ্রলোকের যে আনন্দ তা মনুষ্যলোকের সর্বোত্তম আনন্দের লক্ষণিত।

এতক্ষণ যা বলা হোল তা সবই ঋষিবাক্য। এই সূর্য, চন্দ্র, ও পৃথিবীকে ঘিরে প্রতি ঋতুতে ঋতুতে যে বিচিত্র পরিবর্তন সংঘটিত হয় এবং যা বারবার একই ভাবে আবর্তিত হতে থাকে তাকে লক্ষ্য করেই প্রতি ঋতুতে ভারতীয় জনজীবনে নানা উৎসব। এই উৎসবগুলি বিশ্বের সঙ্গে একাত্মভাবে অবস্থানের স্মারকমাত্র। ঋতুতে, ঋতুতে, কালে কালে সূর্যের ব্রতকর্মানুষ্ঠানেরই অনুকরণ বৈদিক যজ্ঞভূমিতে। সূর্যের উত্তরায়ণ শেষে পুনরায় দক্ষিণায়ন যাত্রার অনুকরণে রচিত উৎসব। আষাঢ় মাসে অম্বু বা বারিবর্ষণের সূচনাতে যখন পৃথিবী বীজধারণযোগ্যা হন, তখন হয় অম্বুবাচী উৎসব। বর্ষণশেষে বিশ্বকর্মা ও শারদীয় উৎসব। দক্ষিণায়ণে বর্ষণকালে দেবরশ্মিগণ যখন পিতারূপে জগৎপালনের জন্য বর্ষণকর্মে নিযুক্ত থাকেন তখন পিতৃযজ্ঞ উৎসব। সূর্য পুরুষ বা আত্মা এবং সূর্যকিরণরাশি স্ত্রী বা পালিকা শক্তি। তাই সূর্যের এক নাম গোপা আর কিরণরাশি গোপিগণ। এই সূর্যকে মন্ডলাকার ঘিরে কিরণরাশির নৃত্যই রাসলীলা। আরভ যেহেতু রাসলীলা আহ্লাদজনক তাই পূর্ণিমার স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় রাস উৎসব। প্রতি সংক্রান্তিতে, সৌর ও চান্দ্রমাসে, পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় এবং বিশেষ বিশেষ তিথিতে ভারতীয় জনজীবনে বিভিন্ন সমাজে যে উৎসব তা সকলই সূর্য ও চন্দ্রকে ঘিরে। ভারতীয় সমাজ ধর্ম দর্শন সাহিত্য পুরাণ স্মৃতিশাস্ত্র সকলই বেদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। ভারতীয় বিবাহ পদ্ধতি, আচার ব্যবহার, রীতিনীতি, গার্হস্থ ধর্ম, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, সঙ্গীতশাস্ত্র প্রভৃতি সকলই এই চার বেদের দ্বারা প্রভাবান্বিত যে বেদের প্রধান আলোচ্য বিষয় আত্মা ও সূর্য। বোইদিক দেবতা অপুরুষবিধ হলেও বিচিত্রলীলাকারী বলে নানা মূর্তী পরিগ্রহও করতে পারেন কিন্তু তাই বলে মূর্তরূপেই তাঁর পূজা করতে হবে বা তাঁকে ভাবনা করতে হবে এমন কথা বেদের কোথাও বলা হয়নি। বেদে এমন কথাও বলা হয়নি যে, বেদবিদ্যা বিশেষ শ্রেণীর কুক্ষিগত। বরং বলা হয়েছে চে, বেদে সকলেরই অধিকার। যে যেমন গুণের অধিকারী সে সেরূপ কর্ম করে সংসারে জীবন যাপন করবে, কৃপণের মত ধনসঞ্চয় করবে না। মেঘ যেমন জলদান না করে অন্ধকার সৃষ্টি করে কৃপণের মত জনসম্পদ নিরুদ্ধ করে রাখে এবং ইন্দ্ররূপী সূর্য বজ্রের আঘাতে সে অন্ধকার নাশ করে জলধারা সকলের জন্য দান করেন, এই দৃষ্টান্তকে অবলম্বন করে ঋষি বলছেন, মনুষ্য সমাজে যে কৃপণের মত ধনসঞ্চয় করে মনুষ্য সমাজের গতি নিরুদ্ধ করে মনুষ্যজীবনে অন্ধকার হতাশা সৃষ্টি করে, তাকে ইন্দের মত বলযুক্ত হয়ে আঘাত করে' সকলের জীবনের গতির জন্য বারিরাশির ধনবন্টন করে দিতে হবে। গুণ অনুসারে কর্ম করার জন্যই চতুর্বর্ণের সৃষ্টি। ব্রাহ্মণের পুত্র ব্রহ্মবিদ্যার অধিকারী না হলে সে সেই অধিকার হতে স্বভাবিকভাবেই বঞ্চিত হয়। যিনি ব্রহ্মতত্ত্ব জেনে অগ্নির মত সমাজকে সুপথে নিয়ে চলেন তিনি যথার্থ ব্রাহ্মণ। যিনি শাসকরূপে অধিষ্ঠিত থেকে সমাজকে ক্ষত বা আঘাত থেকে রক্ষা করেন তিনি যথার্থ ক্ষত্রিয়। যিনি বিশে বিশে অর্থাৎ প্রতি জনের সঙ্গে সন্বন্ধ রেখে প্রতি জনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য বন্টনের ব্যবস্থা করে নিজ প্রয়োজন মেটাবার জন্য পারিশ্রমিক রূপে সামান্যলাভে সন্তুষ্ট থাকেন তিনি যথার্থ বৈশ্য। যিনি কায়িক পরশ্রমের দ্বারা সেবামূলক কাজের দ্বারা নিজ অন্ন সংস্থান করে সন্তুষ্ট তিনিই যথার্থ শূদ্র। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এ ব্যবস্থা সর্বত্রই বর্তমান, যদি না এই ব্যবস্থার বিকৃতসাধনের দ্বারা সমাজকে বিষাক্ত করে হয়। ঋষিও তাই বলছেন, ওহে সোম, আমার মেয়ে যব ভাঙ্গে, আমার ভাই বাণিজ্য করে, আর আমি স্তোত্র পাঠ করি, সুতরাং তুমিও তোমার ধর্ম কর; ইন্দ্রের জন্য জলরূপে ক্ষরিত হও।  এইভাবে বেদের বিষয়কে জেনে ঋক্। যজু, সাম, অথর্ববেদকে যিনি জানেন, যিনি নিয়মিত বেদ অভ্যাস করেন তিনি ক্রমমুক্তির সন্ধান পান যা তাঁকে আনন্দ দান করে, যা তাঁকে পাপমুক্ত করে।